বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ভোট নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা লেগেই আছে। ক্ষমতা বদলের সময় এলেই দেশে বেশি সহিংসতা হয়, দেশটা একটা আতংকের মধ্যে থাকে। কে ভোট নিবে? কীভাবে নিবে? সেসব নিয়ে আন্দোলনের ফলে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা, তা উভয় জোট একবার চাইতে গিয়ে এবং একবার করে না চাইতে গিয়ে আন্দোলন-রক্তপাত-হরতাল করেছে। বরাবরই ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলনই যেন ভোটের ফলাফল। ১৯৭৭ সালের ৩০শে মে’র হ্যাঁ-না ভোট যেটাতে হ্যাঁ ভোট পড়েছিলো মোট ভোটের ৯৮.১% এবং মোট কাস্টিং ভোট ছিল ৮৮%। এরপর এরশাদের প্রায় ৯ বছর ছিলো ভোটের নামে প্রহসন।
৯০ দশকে মোটামুটি লেভেলের ভোট হয়েছে তবে। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারিও একটি খারাপ ভোট দেখতে পাই। ৯৬ সালের নির্বাচনের সব চেয়ে খারাপ দিক হলো ৭৫ এর খুনিদের নিয়ে গড়া ফ্রিডম পার্টির বিরোধীদলের নেতা হওয়া। এই ভোট বিষয়ক খেলায় তত্ত্বাবধায়কের ফাঁক গলে ২ বছর দিব্যি কাটিয়ে গেলো একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০০৮ এ মানুষ ভোটের চমৎকার একটা স্বাদ পায়। ভোট বিপ্লব বলেন, ভোট উৎসব বলেন সেটা ২০০৮ এ দেখা গেছে। ২০১৪তে এসে বাংলাদেশ আবারো হোচট খায়। অনেকটা একতরফা খারাপ ভোটের উদাহরণ তৈরি হয় আবারো। তখন একটা যুক্তি ছিলো যে, বেশির ভাগ দল যেহেতু ভোটে আসে নাই, তাই ভোট যেমন হবার কথা ছিলো তেমন হয়েছে। জয়ী যার হবার কথা সেই যখন জয়ী হয়, তখন কতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আর কতো ভোট পড়েছে সেটা মানুষ খুব একটা দেখেনি।
সদ্য গত হওয়া ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে মনে হয় জয়ী দলটিই এখন অনেকটা বিব্রত অবস্থায় আছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিষয়টা এমন না যে ঐ দলটি খুব ছোট দল, এমন না যে তারা সুষ্ঠু ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতো না। সব আন্তর্জাতিক মিডিয়া ২৯ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রেডিকশন দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিই আবার ক্ষমতায় আসবে, তাদের ব্যাপক উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে এবং শেখ হাসিনার ডায়নামিক লিডারশিপের কারণে। কিন্তু ভোটের মাঠে কী হয়েছে, তা প্রায় সবাই অনুভব করতে পারছে। ভোটের হার/ মোট আসনে জয়ী হবার এবং ভোটের ব্যবধান সব কিছুই চিন্তা করার মতো। অথচ এই দলটিই গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে গিয়ে অনেক রক্ত দিয়েছে, ভোট সিস্টেমের অনেক উন্নতি করেছে। ট্রান্সপারেন্ট ভোটের বাক্সের দাবি পূরণ তারাই করেছিলো এবং সেই ট্রান্সপারেন্ট ভোটের বাক্সে আগের রাতে ভোট এর দায় আবার তাদেরকেই নিতে হচ্ছে। এমনকি পরাজিত পক্ষও প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছে যে, তারা ক্ষমতায় থাকলেও এমন ভোটই হতো। কারণ তারা বলেছে ‘ক্ষমতাসীনদের আন্ডারে যে সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব নয় সেটা প্রমাণিত হলো।’ ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে পরাজিত জোটের কাণ্ডারিহীনতা দেখে, তাদের দৃঢ়তা না দেখে, ভোট বঞ্চিত নিরুপায় মানুষ এসবকে নিয়তি মেনে হয়তো মনে মনে বলছে ‘জন্ম হোক যথাতথা কর্মহোক ভালো।’
ভোট দিতে গিয়ে মনে হলো; ভোট প্রদান/সংরক্ষণের সিস্টেমের অনেক কিছুর আপডেট দরকার। অনেক আইনেরও সংস্কার দরকার। ভোট চলাকালীন সময়ে এজেন্টের সাক্ষর গুরুত্বপূর্ণ, তার সাক্ষর দরকার হয়। তবে একজন এজেন্ট ভোটের ফলাফল পর্যন্ত নাও থাকতে পারেন। অথবা হেরে যাবেন এই আশংকায় এজেন্ট গোপনে ভোট কেন্দ্র ত্যাগ করেন অনেক সময়।
নিজস্ব কিছু সাধারণ ভাবনা আপনাদের কাছে শেয়ার করছি ভোট বিষয়ক:
১। একদিনে সারাদেশে ভোট না হয়ে বিভাগওয়ারী আলাদা আলাদা দিনে ভোট করা যায়। তখন এক বিভাগে ত্রুটি হলে অন্য বিভাগে তা শুধরে নেবার সুযোগ থাকবে।
২। ভোটারদেরকে অনলাইনে আরেকটি নিবন্ধনের মাধ্যমে একটা QR কোড দিবে ভোটের আগেই। ভোটারের সে QR কোড প্রিন্ট করে ভোট কেন্দ্রে গেলে স্ক্যান করবে এবং ভোট প্রদান করবে। ভোট কেন্দ্রে সে অনলাইনেও ভোট দিবে এবং সিল মেরেও ভোট দিবে। অনলাইনের ডাটা মূল সার্ভারে মিনিটে মিনিটে আপডেট হতে থাকবে। তার মানে একজন ভোটার ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া পর্যন্ত তার ভোট অন্য কেউ দিতে পারবে না। QR কোড স্ক্যান করার সাথে সাথে রেকর্ডটি মূল ডাটা সার্ভারে চলে যাবে। ডাটা সার্ভারে জোটদ্বয়ের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবে। ব্যালট ভোট এবং অনলাইন ভোটে বেশি গরমিল হলে তখন পূন:তদন্তের দাবি তোলা যাবে।
৩। ইভিএমকে আরো কিভাবে ইউজার ফ্রেন্ডলি এবং সিকিউরড করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে পারে সব দলগুলো। কারণ এইবারের ভোটে ইভিএমে কারসাজি করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তুলনামূলক অন্য ভোট কেন্দ্রগুলার চেয়ে। নন টেম্পারিং ইভিএম এর উপর জোর দিতে পারে। কেন্দ্রের বাইরে ডিসপ্লে থাকবে অথবা ভোট দেয়ার সাথে সাথে মূল সার্ভারে রেকর্ড হতে থাকবে ইভিএমে।
৪। ভোট কেন্দ্র আরো অনেক কমিয়ে দেয়া যায়। এক ইউনিয়নে একটি বা দুটির বেশি নয়। যাতে এজেন্ট নিয়োগ এবং মনিটরিং এ সুবিধা হয়।
৫। এজেন্টরা ভোটার লিস্ট প্রিন্ট না করে একটা করে ট্যাব নিয়ে বসতে পারে যেখানে ঐ ভোট কেন্দ্রের সব ভোটারের ডাটা দেয়া থাকবে। এতে কাগজ এবং সময় বাঁচবে। ভোটার আইডি দিয়ে সার্চ দিলেই তার কেন্দ্র তথ্য বের হবে।
৬। ভোট কেন্দ্রের বাইরে একটা এলইডি মনিটর থাকবে। যেখানে মোট ভোটার সংখ্যা এবং কাস্টিং ভোট মিনিটে মিনিটে আপডেট হতে থাকবে।
যদিও জানি মানসিক সততা না থাকলে কোন সিস্টেমই কাজ করবে না। তারপরও হয়তো আমাদের চাওয়াগুলো অনেকটা নিম্নরূপ-
ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু নাম না হয়ে এসব ত্রুটি বিচ্যুতি বন্ধের কাজে ব্যবহৃত হোক। জয়ী এবং পরাজিত দুইটা দলই মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ থাকুক। রাজাকারে গাড়িতে পতাকা আর না উঠুক। দলগুলার ভেতরও গণতন্ত্রের চর্চা থাকুক। মনোনয়ন নিয়ে টালবাহানা/মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হোক। তৃণমুল থেকে স্ব স্ব দলে নির্বাচনের মাধ্যমে মনোনীত ব্যক্তি উঠে আসুক। একদল থেকে বের হয়ে আরেক দলে গিয়ে একদিনের মধ্যেই মনোনয়ন না পাক। অন্তত তিন বছরের টাইম লিমিট থাকুক তাহলে হয়তো ভোটের নামে, দলের নামে, দেশ শাসনের নামে দুর্বৃত্তপনা কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।
নিজ নিজ দলের প্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীকে নির্বাচন না করতে পারার বাধ্যবাধকতা থাকুক। রাজনৈতিক মেরুকরণের নামে সিন্ডিকেট বন্ধ হোক। প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিজেদের রাজনীতি করুক। জোট করে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট না করুক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)