বিএনপি’র সব পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন হতাশ, ক্ষুব্ধ বীরবিক্রম শমসের মবিন চৌধুরী। সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা মবিন স্বাধীনতার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে আসেন। জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময় তিনি পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পান। ২০০৫ সালে তাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ওয়াশিংটন পাঠানো হয়।
২০০৭ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে ২০০৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিএনপি নেত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা বানানো হয়। ২০০৯ সালে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন। সেনা কর্মকর্তা থেকে জনপ্রশাসন তারপর রাজনীতিতে আসা শমসের মবিনের কর্মজীবন ছিলো বর্ণাঢ্য।
মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরীর দীর্ঘ কর্মজীবনে দুটি বিষয় বেশ আলোচিত। ব্যক্তিগত তদারকিতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মবিনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। শারীরিকভাবে দূর্বলতার কারণে তাকে মেজর থাকা অবস্থায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনিই।
সেই শমসের মবিন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এক নিমিষে জেনারেল জিয়ার অনুগত বিশ্বস্থ কর্মচারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পুরস্কার স্বরূপ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর কাজটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার হাতেই সম্পাদিত হয়েছিলো। একজন বীরবিক্রম কিভাবে নিজ হাতে মুক্তিদাতার হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করতে পারেন তা জাতিকে ভাবায়। বিভিন্ন আলোচনায় শমসের মবিনের এই বিতর্কিত ভূমিকার সামালোচনা হয়।
২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধী রক্ষা আন্দোলনে এবং ২০১৫ সালের মানুষ পোড়ানো আন্দোলনে আন্তর্জাতিক কুচক্রীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের আনুষ্ঠানিক সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেগম খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক এ উপদেষ্টা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে এবং বিশেষ করে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় জামায়াতে ইসলামী প্রভাবিত জঙ্গিবাদী রাজনীতিকে তিনি সুচারুভাবে গণতান্ত্রিক আবরণ দিয়ে পশ্চিমাদের কাছে উপস্থাপন করার পারদর্শীতা দেখিয়েছেন।
জঙ্গিবাদকে ঢেকে তিনি পশ্চিমা মিডিয়া এবং তথাকথিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনদের সুন্দর সুন্দর গণতান্ত্রিক কথা বলেছেন। এ কাজে সাফল্য দেখিয়ে তিনি বিএনপি নেত্রীর যথেষ্ট আস্থাভাজন হয়েছিলেন। তাকে বেগম জিয়ার গুলশান অফিসের ইনার সার্কেলের লোক হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
শমসের মবিন চৌধুরী বেগম জিয়ার আস্থাভাজন হিসেবে পরিগণিত হলেও তাল মেলাতে পারেননি তার ছেলের সঙ্গে। ২০১৩ সালে লন্ডনে অবস্থিত তারেক জিয়ার সঙ্গে ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলোচনায় তাদের দুজনের সম্পর্কের ঘাটতিগুলো স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে। সে আলোচনায় বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ট সহচর মবিন চৌধুরীর সঙ্গে জিয়া পুত্র তারেক রহমান যে ভাষায় কথা বলেছেন; তাকে কোনভাবেই দুজন নেতার মধ্যে আলোচনা বলা যায় না। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন ব্যাপার সেখানে ছিল না। তারেক রহমান শুধু নির্দেশ দিয়েছেন আর শমসের মবিন ওই নির্দেশের উত্তরে শুধু ‘জ্বি হুজুর’ করে গেছেন।
এ আলোচনা থেকে এটাও বোঝা যায় যে তারেক রহমানের চাপিয়ে দেওয়া সহিংসতার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তার দ্বিধা হচ্ছিল। তিনি চাচ্ছিলেন সহিংস আন্দোলন পিছিয়ে দিয়ে সরকারের সঙ্গে কোন একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে। তারেক রহমান ছিলেন ঠিক তার বিপরীত মেরুতে।
পদত্যাগ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শমসের মবিন চৌধুরীর রাগ, ক্ষোভ ও হতাশা গোপন থাকেনি। তিনি বলেছেন, বর্তমানে বিএনপিতে প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘আদর্শ’ কতটুকু আছে তা নিয়ে তার মনেও প্রশ্ন রয়েছে। জিয়াউর রহমানের আদর্শ বলতে আসলে কি বোঝায় সে ব্যাখ্যায় তিনি যাননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; সেনাবাহিনীতে ও জনপ্রশাসনের উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের, কায়েম করেছিলেন পাকিস্তানী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ; ধ্বংস করেছিলেন সংবিধানের তিন মূলস্তম্ভ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। এ সকল স্বাধীনতা বিরোধী কর্ম সম্পাদনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এ বীরবিক্রম।
এতসব কিছুর পরেও এ কথা সত্য যে জিয়াউর রহমান জঙ্গিবাদী রাজনীতি করেননি। তার পুত্র তার হাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে যৌথভাবে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের রাজনীতি করছেন। মবিন হয়তো এই পার্থক্যের কথাই বলতে চেয়েছেন। তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন জঙ্গিবাদী বিএনপি তিনি মানতে পারেননি বলেই তার যত রাগ, ক্ষোভ, হতাশা থেকে ত্যাগ করেছেন বিএনপি’র সবগুলো পদ। তবে পদত্যাগপত্রে কারণ হিসেবে তিনি শুধু শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন।
পদত্যাগের পর দিন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শমসের মবিন চৌধুরীর এলাকা সিলেটে ঝটিকা সফরে গিয়ে বলেছেন, “পদত্যাগে দলের কোনো ক্ষতি হবে না। বিএনপি একটি বড় দল। এখানে কোনো ব্যক্তির পদত্যাগে ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। ব্যক্তি আসবে যাবে; কিন্তু দলে এতে প্রভাব পড়বে না।”
মির্জা আলমগীরের ঝটিকা সিলেট সফর অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। তিনি সেখানে না গেলে বিএনপি’র একাংশ কি দল থেকে বেড়িয়ে যেত? তিনি কি সেখানে গিয়ে ভাঙ্গন ঠেকিয়েছেন? সিলেটে ভাঙ্গন শুরু হলে তার ঢেউ কি অন্যত্র গিয়ে লাগত না? এমন সব প্রশ্ন জেগেছে জনমনে। মির্জা আলমগীরের মতো বিএনপি’র অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক একই কথা বলছেন। তত্ত্বগত ভাবে আলমগীর সাহেবের কথা ঠিক হলেও স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় তত্ত্বকথা মেনে নেয়া কঠিন।
মবিন এমন সময়ে পদত্যাগ করেছেন যখন বিএনপি ইতিহাসের সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্দেহ-অবিস্বাস আকাশচুম্বী। কেউ কারো কথা শুনছে না। দলীয় নির্দেশ এবং কর্মসূচি বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ঘোষণা করছেন। কেউ কারো নির্দেশ মানছে না। মানুষ পোড়ানো আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর তৃণমূল পর্যায় থেকে বিএনপি সংস্কারের কথা অনেক বার বলা হলেও সংস্কার দেখা যায়নি।
বিএনপি নেত্রী পনের দিনের জন্য লন্ডন যাওয়ার কথা বলে আজ দেড়মাস পরেও বোঝা যাচ্ছে না তিনি কবে ফিরবেন। আদৌ ফিরবেন কিনা সে প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। দুই বিদেশী হত্যার রহস্য অনেকখানী উম্মোচন হয়েছে। সন্দেহের তীর ধীরে ধীরে তারেক রহমানের দিকে ঘুরছে। তার সঙ্গে আরও কিছু সিনিয়র নেতা এই মামলায় জড়িয়ে যেতে পারে।
বেগম জিয়ার দুর্নীতির মামলাগুলোর রায় ঘনিয়ে আসছে। নতুন করে পুলিশ হত্যা এবং হোসেনী হালান হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে দোসর জামায়াতের প্রতি আইনি জাল আরও শক্ত হচ্ছে। সহযোগী জেএমবি, হুজি, আন্সারুল্লাহ বাংলা টিমের বহু জঙ্গি গত কয়েক মাসের মধ্যে ধরা পড়েছে। সব মিলিয়ে বিএনপি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে শমসের মবিন চৌধুরীর মতো শক্তিশালী একটি খুঁটি ভেঙ্গে পড়া বিএনপিকে দূর্বলতর করেছে নিঃসন্দেহে। সরকারী দলের নেতারা বলছেন, আরও অনেকে শমসের মবিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। যদি তাই হয় তবে তার পদত্যাগ হবে বিএনপি’র শেষের শুরু।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)