চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

একজন মকবুলের খবর কেউ রাখে না

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। এই দিনে মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি বীর ও বেঈমানের জাতি এই দ্বৈত চরিত্র তুলে ধরল বিশ্বদরবারে। শত সতর্কীকরনেও বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের প্রতি বিশ্বাস হারা হননি। কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারেনা জীবদ্দশায় এই বিশ্বাসে তিনি অটল ছিলেন।

কিন্তু ১৫ আগস্ট তার এই বিশ্বাসকে হত্যা করা হল। ইতিহাসের এই বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের পরে কথা ছিল তার দল আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মী ও জনগণকে রাস্তায় নেমে আসা। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ ট্যাংকের সামনে দাঁড়ালে কজনকে হত্যা করত ঘাতকেরা? তবে হ্যাঁ, কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিল, নেমেছিল প্রতিরোধ যুদ্ধে।এখানেও বাঙালি পরিচয় দিল কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ জাতির দ্বৈত চরিত্রের।

আজকের ১৫ আগস্ট যেনো পণ্য হয়ে গেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাহারি পোস্টার। পোস্টার গুলোতে শোকের চেয়ে আত্মপ্রচারই বেশী ফুটে ওঠে। শোকদিবসের মাধ্যমে কে কতবড় নেতা,কে কত বড় আমলা, কে কত মুজিব ভক্ত সাজতে পারে, এ যেন তারই প্রতিযোগিতা। একটা কথা আছে, সাধু সেজোনা, সাধু হও। ১৫ আগস্টকে ঘিরেও ঠিক তেমনই মুজিব ভক্ত হওয়ার চেয়ে মুজিব ভক্ত সাজাটাই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। খবর বেরিয়েছে যারা মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেছিল সেই বীর বাঙালি প্রতিরোধ যোদ্ধারা চরম কষ্টে, অবহেলায়, অনাদরে দিন কাটাচ্ছে। ১৫ আগস্টে তাদের দাওয়াতও করা হয়না। আর যারা ১৫ আগস্টে লুকিয়েছিল, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা, নীতিতে কিংবা কেউ কেউ খুনী সরকারের সাথে আঁতাতও করেছিল। আজ অনেক ক্ষেত্রে তারাই শোক দিবসে শোক প্রকাশের বড় আয়োজক।

আজকের শোকের সিকিভাগ লোক যদি সেদিন প্রতিবাদ করত তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী মোশতাক প্রেসিডেন্ট হয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারতনা। চেতনার শোক হতে বেরোয় প্রতিবাদ আর ক্ষমতার শোক হতে বেরোয় সুবিধাবাদ। দল পাওয়ারে না থাকলে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা ১৫ আগস্টে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে শোক জানাতে রাস্তায় উঠতোনা। সরকারি অফিস আদালতে, প্রেস ক্লাবে, বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক সংগঠনে মুজিবের ছবি শোভা পাচ্ছে কি চেতনার জোরে না ক্ষমতার জোরে? এগুলোও ভাবা দরকার।

দেশজুড়ে শোকদিবসকে উৎসবে পরিণত করা হয়েছে। এদিবসে কোথাও কোথাও চিত্রাঙ্গন প্রতিযোগিতাও হয়। কারও বাবার মৃত্যুর দিন উপলক্ষ্যে কেউ কি বাড়িতে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা দেয়? ১৭ আগস্ট, দৈনিক ভোরের ডাকে খবর বেরিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদ ফটকের নিকট বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে যুবলীগ নেতা। কারণ একটাই তার প্রতিপক্ষ যুবলীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর ছবি সহ ব্যানার দিয়ে বেশি প্রচার সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে এটা মানতে পারার বিষয় না! ওই ব্যানারে তার ছবি ও নাম থাকলে নিশ্চয়ই তিনি তা ছিঁড়তেন না। দল করে দলের ভেতরে প্রতিপক্ষ ভেবে জিঘাংসা সৃষ্টির পরিণতি যে ভয়াবহ হয় এর চাক্ষুষ উদাহরন বঙ্গবন্ধু হত্যা।

ধর্মপাশার যুব লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল আর আওয়ামী লীগ নেতা মুশতাক বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে দুনিয়া হতে ছুঁড়ে ফেলল। যদি বলা হয় সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী অফিসারদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন এটা ঠিক হবেনা। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় বসেনি। ক্ষমতায় বসেছে আওয়ামী লীগ নেতা মুশতাক সহ আরও কয়েকজন। এককথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি জিঘাংসা পরায়ন রাজনৈতিক অপশক্তিই এই হত্যাকাণ্ডের মূলে।

আর এদের উস্কে দিয়েছিল পাকিস্তান হতে স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়ের বিপক্ষে থাকা দেশীবিদেশী কুচক্রী মহল। ১৫ আগস্ট উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় লাখ লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলিত হয়েছে। অনেকেই সে টাকা হতে আত্মসাতও করেছে।এছাড়া প্রতি কমিটির নেতারা , এমপিরা, এমপির এপিএস/পি,এরাও চাঁদা দিয়েছে। প্রতি উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা দশ হতে পনেরো হাজার, থানা কমিটির সদস্যরা পাঁচ হতে তিনহাজার টাকা পর্যন্ত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে এমপি ও তার এপিএস/পি,এর সমান চাঁদা।

প্রতি জেলা, উপজেলায় জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে কতো টাকা চাঁদা উত্তোলিত হয়েছে, কোন উপজেলায় কত টাকা উদ্বৃত্ত থেকেছে, কোন উপজেলায় থাকেনি এব্যাপারে দলীয় ফরমে তথ্য আহবান করা আবশ্যক। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শোক দিবস আর ক্ষমতার বাইরে থাকার শোক দিবস, এদুয়ের পার্থক্যও অনুধাবন করা দরকার। আওয়ামী লীগের কজন এমপি নিজের এলাকায় শোকদিবসে অংশ নিতে এলাকায় গেছেন ও কতজন যাননি এবিষয়টাও জানা দরকার। দলে অনেক অনুপ্রবেশকারী ঢুকে ঘাপটি মেরে আছে।

আওয়ামী লীগ দলীয় সুবিদ আলী ভুঁইয়া যেমন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব অস্বীকার করে জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেছেন। এরকম জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগার এমপি আরও রয়েছে। সুবিদ আলী ভুঁইয়া ও মোশতাকের বাড়ি একই এলাকায়। তিনি খালেদা জিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ছিলেন। তিনি ওখানে এমপি হওয়ার সুযোগ না পেয়ে আওয়ামী লীগে এসে এমপি হয়ে গেলেন কিন্তু মুজিব ভক্ত আওয়ামী লীগার হতে পারেন নি। তিনি যে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েও বিএনপি রয়ে গেছেন তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে সকলকে দেখিয়ে দিলেন। তবু যদি নীতি নির্ধারকদের বোধের উদয় না হয়!

এরকম জেগে ঘুমালে কার সাধ্য এঘুম ভাঙ্গাবে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাতীয় চার নেতার এক নেতার পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনেক আগেই বলেছেন, ছাত্রলীগে শিবির ঢুকে গেছে। তিনি কি আজ একথাটি বলবেন এমপিদের মাঝেও মুশতাকপন্থী ঘাতকের অনুসারি ও বিএনপি ঢুকে গেছে। এই কথাটি বলা আজ সময়ের দাবী।

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে সংসদীয় দলের সভায় এমপিদের এলাকায় যেতে বলেছেন। কই তারা কেউ গেলেন নাতো। এমনকি জাতির পিতার হত্যার দিনটিতেও অনেকেই যান নি।এই দিনটিতে নির্দেশের মাধ্যমে যাওয়ার কথা নয় চেতনার টানে যাওয়ার কথা।

চেতনার টানে শোক পালনের সুস্পষ্ট উদাহরণ নালিতাবাড়ির মুজিব ভক্ত মকবুল হোসেন। তিনি ১৫ আগস্টের পর হতে আজ পর্যন্ত কালো কাপড় পরে শোক পালন করে চলছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালে তাকে এই মুজিব প্রেমের চরম মাশুল দিতে হয়েছে। ভিটাছাড়া হয়ে তিনি বউবাচ্চা নিয়ে শ্যামলীর বস্তিতে থাকছেন। তার বয়স একশোর কাছাকাছি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে তিনি রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছেন। এসব মানুষের খবর কে রাখে। মুজিব ভক্তির কারণে বিএনপি জামাতের আমলে মকবুল হোসেন ভিটা ছাড়া হলেন। সেটা সেখানকার আওয়ামী লীগার ও সংসদ সদস্যের না জানার কথা না।

মকবুল হোসেনকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদনও বেরিয়েছে। নালিতা বাড়ির সংসদ সদস্য কি কখনও তার খবর নিতে চেয়েছেন? টেন্ডারবাজী, সিন্ডিকেট বাণিজ্য,উপদল চর্চা প্রভৃতির ভিড়ে মকবুল হোসেনের মত অসহায় মুজিব প্রেমির খবর নেয়ার কার দায় পড়েছে?

সকলে ব্যস্ত রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে পণ্য করে নেতৃত্বের পরিচিতি,নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের আখের গুছানো নিয়ে। শুধু এই একা সুবিদ আলী ভুঁইয়া নয় আরও অনেকেই রয়েছে।।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)