নিয়ন্ত্রণহীন অার যে কোনো জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকা বেপরোয়া বাস চালকদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। হাত হারানো রাজীবের পর ৯ দিন আগে পা হারানো গৃহকর্মী রোজিনার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে হতাশা প্রকাশের পাশাপাশি নানান পরামর্শও উঠে এসেছে।
রোজিনা আক্তার পা হারিয়ে যখন হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, ঠিক সেই সময়েই শনিবার বাসচাপায় পা হারিয়ে সেই মৃত্যুর সাথেই পাঞ্জা লড়ছেন আরেক রাসেল সরকার নামে এক প্রাইভেট কার চালক।
গত কয়েকদিন ধরে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটেই চলছে।
রোজিনার মৃত্যুর পর সাংবাদিক ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ ফেসবুকে দেয়া তার পোস্টে লিখেছেন: ‘রোজিনার মৃত্যু দুঃখজনক। কিন্তু এখানে দায় তার নিজের। পাশেই ওভারব্রিজ রেখে দৌড়ে রাস্তা পারাপারের মানে ছিল না।’
তবে ওই পোস্টে ভিন্নমত পোষণ করে ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট এবং ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান মন্তব্য করেন: ‘এই দেশে সব দোষ মানুষের। রাষ্ট্রের কোন দায় নেই। যাও ঢাকার ওভারব্রীজগুলো দেখ। ফুটপাতগুলো দেখ। পারলে হাঁটো।’
তিনি আরও লিখেছেন: ঢাকার ৯০ শতাংশ ফুটপাত চলাচল অনুপযোগী। গুলশান বনানী দিয়ে ঢাকা বিবেচনা করো না। ঢাকা দক্ষিণে যাও। মিরপুরে যাও।
‘‘আইন মানার প্রবনতা যেমন আমাদের কম তেমনি ফুটপাত ওভারব্রিজগুলো গুলো উপযোগী নয়। আমি নিজে ফুটপাতে হাঁটি। ওভারব্রীজেও উঠি। আমার সাথে একদিন চলো। বুঝবা কতোটা বাজে অবস্থা। আর ঢাকার সড়ক আর বাসগুলো যে বিশৃঙ্খল সেটা তো না মানার কোন কারণ নেই তাই না? সিএনজিতে মিটারে কী আনতে পারলো রাষ্ট্র? জনগনের দোষ কী এখানে? আর ব্যক্তির আইন মানা ও রাষ্ট্রীয় সুশাসন দুটো পরিপূরক। একটা হলে অন্যটা হয়।’’
শরিফুল হাসানকে উদ্দেশ করে সাংবাদিক উদিসা ইমন মন্তব্য লিখেছেন: আমি মৃত্যু জায়েজ করছি না। কিন্তু ঢাকায় গত ১৫ বছরে আমি একদিনও আন্ডারপাস, ওভারব্রিজ বা জেব্রাক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হই নাই। কারণ আমি ভয় পাই। আমার মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হতে পারে, হতেই পারে। কিন্তু আমি এটুকু সাবধানতা মেনে চলি। কোনদিন কেউ আমাকে সার্কফোয়ারা দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখে নাই। আমি ঘুরে হেঁটে গিয়ে আন্ডারপাস ব্যবহার করেছি। কারণ আমি সাহসী নই। সকালে রোজ যখন অফিসে আসি।
‘আড়ং সিগন্যাল থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত গাড়িতে জানটা হাতে নিয়ে বসে থাকি। মানুষ অবলীলায় জাস্ট হাতটা দেখায়ে ‘স্মার্টনেস’ নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, গাড়ির দিকে খেয়ালই করে না। ওই হা দেখেই যেন দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা গোটা বিশ্বের। এবং যদি কোন চালক সেসময় হর্ন দিয়ে তাকে সাবধান করে, যে চোখ রাঙানি দেয় সেটা বোধহয় চোখে পড়েনি তোর কথনও। বিস্মিত হচ্ছি চোখে না পড়লে। এসব বন্ধ হওয়া দরকার।’
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সাংবাদিক ফাহমিদা আখতার লিখেছেন: কয়েক দিন আগে কারওয়ান বাজারের আন্ডার পাসে যেতে বড় সড় লাফ দিতে হয়েছে। পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়েও লাফ দিয়েছি। এগুলো ঠিকঠাক রাখার দায়িত্বও পালন করতে হবে।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উদাহরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন: ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আমরাই, এই একই দেশের মানুষ সিদা হইয়া চলি। সব রাস্তায় ট্রাফিক আইন না মানার জন্য সাধারণ থেকে অসাধারণ (সচিব, বিচারপতি, সুশীল ইত্যাদি) নাগরিকদের শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা, ট্রাফিক জ্যাম নাই হয়ে যেতো।
সরকারি কর্মকর্তা নাজমুল আলম নবীন লিখেছেন: ফুট ওভারব্রিজ কোন টেকসই সমাধান না! জেব্রা ক্রসিং অনেক মানবিক। আমাদের যদি আইন মানার প্রবনতা থাকতো তাহলে ফুট ওভারব্রিজ লাগতো না। এটা পুরো সমাজ হিসেবে আমাদের দায়। রাষ্ট্রের তো আছেই। সমাজেরও আছে, ব্যক্তিরও আছে। আমরা আইন মানতে চাই না। কিন্তু অন্যকে মানতে বলি।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থানরত এ কর্মকর্তা সে দেশের উদাহরণ টেনে বলেছেন: এখানে ৮০ বছরের বৃদ্ধও, টোটালি এম্বুলেন্ট মানুষও কারো সাহায্য ছাড়া এক স্টেট দিয়ে অন্য স্টেটে যেতে পারবে। সেটাতে রাষ্ট্র যেমন আইন করার ব্যাবস্থা রেখেছে। সমাজ সামগ্রিক ভাবে সেটাকে চর্চা করে করে পোক্ত করেছে।
গত ২০ এপ্রিল রাজধানীর বনানী এলাকায় বিআরটিসির দোতলা বাসের চাপায় ডান পা হারান গৃহকর্মী রোজিনা। রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে-আইসিইউতে মৃত্যু হয় তার।
এর আগে ১৬ এপ্রিল এই হাসপাতালে মারা যান সার্ক ফোয়ারার সামনে দুই বাসের মধ্যে চাপা পড়ে হাত হারানো রাজীব হোসেন।