উপজেলা নির্বাচন মোটেও প্রতিযোগিতামূলক হবে না, এমনটি আশংকা করছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো বড় বড় রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটা হতাশাব্যঞ্জক খবর। আমরা সবসময় চাই, সবসময় চেয়েছি যে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে এবং সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।’
১৭ ফেব্রুয়ারি রোববার আগারগাঁওয়ে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (ইটিআই) ভবনে উপজেলা নির্বাচনের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ (টিওটি) কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ রকম মন্তব্য করেন তিনি।
আগামী ১০ মার্চ শুরু হচ্ছে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এদিন ৮৭ উপজেলায় ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচনের শুরু হবে। এরপর নির্বাচন কমিশনের সূচি অনুযায়ী অন্যান্য উপজেলাগুলোতে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো আগ্রহ নেই। বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা শুরু থেকেই বলেছে এই সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। অতএব উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করছে না। একইভাবে বাম দলগুলোও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অথচ বিগত দিনগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচন নিয়ে মানুষের মাঝে তীব্র আগ্রহ থাকতো। উপজেলা নির্বাচন এলে গ্রামেগঞ্জে একটি উৎসবমূখর পরিবেশ তৈরি হতো।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে শাসকদলের নানা দোদুল্যমনতাও অনেকের কাছে বিরক্তকর মনে হয়েছে। এক একসময় আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের দেখা গেছে একেকরকম কথা বলতে। বিশেষ করে প্রথমে দলীয় প্রতীক এবং দলীয় মনোনয়নে উপজেলা নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হলেও পরবর্তীতে ঘোষণা দেওয়া হয় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এরমধ্যে আবার বলা হয় ভাইস চেয়ারম্যান পদেও দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। সবশেষে আবার বলা হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান পদ উন্মুক্ত।
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলেও আবার বলা হয়েছে দলের কেউ ইচ্ছে করলে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে। এতে কেউ বাঁধা বিঘ্নের সৃষ্টি করবে না। অর্থাৎ কেউ বিদ্রোহী হলে অসুবিধা নেই। আপাতত এভাবেই আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। তবে দলীয় মনোনয়ন নিয়েও যথেষ্ঠ অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। অনেক থানা এবং জেলা কমিটির বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বা স্থানীয় এমপির নির্দেশে অনেক জেলা কমিটি কেন্দ্রে একক কমিটি প্রেরণ করেছে। ফলে কূটকৌশলের কারণে অনেক ভালো প্রার্থী বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এখানেও আওয়ামী লীগ তার সঠিক স্বচ্ছ সাংগঠনিক তৎপরতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। একক প্রার্থী পাঠানোর বিষয়ে আওয়ামী লীগ সুযোগ রাখার কারণে অনেক থানা ও জেলা কমিটি অনেক ভালো প্রার্থীর প্রতি সুবিচার করেনি। উল্টো তাদের প্রতি মারাত্মক অবিচারই করেছে। তবে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বাছাই কমিটি এখন পর্যন্ত অনেক একক প্রার্থীকেই আমলে নেয়নি-এটি অত্যন্ত ভালো সংবাদ।
সমাগত উপজেলা নির্বাচন কেমন হবে-এটি এখন অনেকের কাছেই প্রশ্ন। এই প্রশ্ন এখন দোল খাচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলের কাছেও। ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলগুলোর মধ্যে জাসদ এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির অনেক উপজেলাতেই ভালো বা যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন স্বচ্ছ-সঠিক হবে কিনা এই প্রশ্নে শরীক দলের প্রার্থীরাও নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কেননা শরীক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এখন মনে করেন নির্বাচনে দাঁড়িয়ে শুধু শুধু অর্থ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও শরীক দলগুলো বলেছে তারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু একথা বললেও শরীক দলগুলোর তৃণমূলে চোখে পড়ার মতো কোনো তৎপরতা নেই।
একইভাবে মহাজোটের অন্যতম দল জাতীয় পার্টিও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে খুব একটা তৎপর না। বর্তমান সিইসির অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে তারাও মনে করছে। এর বড় প্রমাণ হলো জাতীয় নির্বাচনের পর বন্ধ থাকা গাইবান্ধা-৩ আসনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল জাসদ এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে একটুও ছাড় দেয়নি। আর তাই নির্বাচনের দিন জাসদ প্রার্থী এসএম খাদেমুল ইসলাম খুদী নির্বাচনে ভোট অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। ‘উপজেলা নির্বাচন মোটেও প্রতিযোগিতামূলক হবে না’-সিইসির এই উপলব্ধি তাকে যেমন আমলে নিতে হবে তেমনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকেও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
রাজনীতি এবং নির্বাচনের মূল সৌন্দর্যই হলো- সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে ততই বিষয়টি যেনো ফিকে হয়ে আসছে। ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দেওয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। এ কথাতো সত্য খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্ধী না থাকলে খেলা হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে খোদ দলের মধ্যেও যোগ্য-দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি হয় না। ক্ষমতাসীন দলকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে যে হতাশা ব্যক্ত করেছেন এতো গোটা রাজনীতিরই হতাশার চিত্র। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হচ্ছে কেউ জানেই না। কোথাও কোনো তৎপরতা নেই। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নিশ্চয় মনে মনে মারাত্বক খুশি। শুধু দিনক্ষণটা পার হয়ে গেলেই তিনি জয়ী। এতবড় সুযোগ হয় নাকি!
সব দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে না পারাটা কী নির্বাচন কমিশনের দায়ের মধ্যে পড়ে না? এ দায় তিনি এড়াবেন কীভাবে? শুধু হতাশা প্রকাশ করলেই হবে না, হতাশা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)