ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলের ইশতেহারে কী আছে না আছে, সে বিষয়ে শিক্ষিত-সচেতন জনগোষ্ঠীর কিছু আগ্রহ থাকলেও, প্রান্তিক মানুষ এ নিয়ে কতটা ভাবে—তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
ইশতেহার দেখে মানুষ ভোট দেয় কি না, ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, ক্ষমতায় গেলে দলগুলো তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে কিংবা ইশতেহারে নেই এমন কোনো বিষয় সংবিধান সংশোধন করে বা অন্য কোনোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে কি না—যা নিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এরকম বাস্তবতায় আমরা একটু জানতে চাই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির ইশতেহারে কী থাকছে বা কী থাকা উচিত বলে নাগরিকরা মনে করেন?
নির্বাচনী ইশতেহার হচ্ছে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র পরিচালনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা, নিজ দলের আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা এবং জনগণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার৷
রাজনীতিবিজ্ঞানে ‘ইশতেহার’ বা ‘মেনিফেস্টো’ শব্দটির প্রথম বৃহৎ উচ্চারণ ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’। ১৮৪৮ সালে মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কর্মসূচির দলিল এই ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’। এর প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘বুর্জোয়া ও সর্বহারা’। এই অধ্যায়ে তাঁরা সমাজ বিবর্তনের নিয়ম এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার দ্বারা অন্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার অপসারণের অনিবার্যতা তুলে ধরেন।
এভাবে ‘সর্বহারা ও সাম্যবাদী’, ‘সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সাহিত্য’ ইত্যাদি অধ্যায়ে তাঁরা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের আদর্শ বর্ণনা করেন। ঐতিহাসিক এই ইশহেতারের স্লোগান ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’—যেখানে ঘোষণা করা হয়, শ্রমিকশ্রেণি বা সর্বহারাদের শৃঙ্খল ছাড়া আর হারানোর কিছু নেই।
জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো যে ইশতেহার বা মেনিফেস্টো ঘোষণা করে তার সাথে এই কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর তফাৎ হলো, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো একটি আদর্শিক ঘোষণা যা সারা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য এবং ১৮৪৮ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় এবং অন্যান্য মতাদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রসমূহের কমিউনিস্টদের কাছে এটি এখনও গৃহীত। কিন্তু নির্বাচনপূর্ব ইশতেহার পরিবর্তনশীল এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য এটি ভিন্ন। কেননা প্রতি বছরই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানারকম পরিবর্তন হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে জনতুষ্টি মাথায় রেখে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। স্বভাবতই সেখানে অনেক কথার ফুলঝুরিও থাকে। কেননা তারা যেসব প্রতিশ্রুতি বা কর্মসূচি ঘোষণা করে, পাঁচ বছর মেয়াদে তার সব বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দীর্ঘদিনের অব্যাহত চর্চা বিশেষ করে গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিরাজমান থাকা আবশ্যক। যেমন কোনো দল যদি তাদের ইশতেহারে ঘোষণা করে যে তারা আইনের শাসন নিশ্চিত করে একটি মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র গড়ে তুলবে—তাহলে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন মাত্র ৫ বছরে সম্ভব নয়। আবার সরকারের একার পক্ষেও এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ একটি রাষ্ট্রকে মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে অপরাপর সকল দলের আন্তরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তুলতে না পারলে মানবিক মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে ‘দিনবদলে’র নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিলো, মনে করা হয় ওই ইশহেতার তরুণ প্রজন্মের ভোট আকর্ষণে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলো। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাদের ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’—যেখানে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমানা নাগালে রাখা, শিল্পায়ন বাড়ানোসহ নানা প্রতিশ্রুতি ছিল। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছিল ওই ইশতেহারে।
বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় ওই বছর তারা কোনো ইশতেহার না দিলেও পরবর্তীতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের একটি লক্ষ্যমাত্রা ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেন—যেখানে সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কথা বলা হয়। রূপরেখায় মানবাধিকার, সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দূর করারও অঙ্গীকার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা ভারসাম্য করতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সংস্কার এবং দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ গঠনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলা হয় ভিশন ২০৩০-এ।
এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইশতেহারে কী থাকছে? ২৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ইশতেহার উপকমিটির বৈঠক শেষে দলের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানান, ইশতেহারের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী ১১ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হতে পারে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং দারিদ্র্যের হার কমানোর লক্ষ্য সামনে রেখে এবার আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা করার ইঙ্গিত দেন তিনি। তবে শোনা যাচ্ছে, এবার দলটির ইশতেহারে গ্রামকে শহর বানানো তথা শহরের সুবিধা গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার থাকতে পারে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যেও গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কথা উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ইস্যুতে তরুণদের একটি বড় অংশের সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে এবার আওয়ামী লীগের ইশতেহারে তরুণদের নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা থাকতে পারে বলেও জানা গেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির ইশতেহারে এবার রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, দুদকের সংস্কার, সরকারি অর্থায়নে দরিদ্রদের শিক্ষা চিকিৎসা ও বাসস্থান, চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫, চাহিদা অনুযায়ী কোটা সংস্কারের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেতে পারে। সেইসাথে এ মুহূর্তে দেশের অন্যতম বড় সংকট রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর অঙ্গীকারও থাকতে পারে তাদের ইশতেহারে।
তবে মনে রাখা দরকার, দেশের মোট ভোটারের প্রায় ১৫ শতাংশ তরুণ। সুতরাং তাদের গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ করে তাদের কর্মসংস্থান, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ও কোটা ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসা উচিত প্রধান দুই দলের তরফেই। তবে শুধু ঘোষণাই নয়, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল ও সময়সীমাও ইশতেহারে থাকতে হবে। ইশতেহার শুধুমাত্র জনতুষ্টির কথা ভেবে কথার ফুলঝুরি হয়ে থাকার বিষয় নয়। বরং এটি রাজনৈতিক দলের বিশ্বাস, দর্শন ও আদর্শেরও প্রতিফলন। সুতরাং রাষ্ট্রের সর্ত্র দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন রোধ, গণতান্ত্রিক চর্চা, মানুষের কথা বলা তথা ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে প্রধান দলগুলো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে—এটিই দেশের মানুষের প্রত্যাশা। এ মুহূর্তে যে জঙ্গি ও উগ্রবাদ সারা বিশ্বের জন্যই একটি বড় বিপদ—তা থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষায় সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ বিকশিত হওয়ার পথ বন্ধ করতে দীর্ঘমেয়াদে কী করা হবে—তারও ঘোষণা থাকা দরকার।
সর্বোপরি কথা হচ্ছে, ভোটের মাঠে খুব একটা গুরুত্ব বহন না করলেও ইশতেহারের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। কেননা একটি দলের ইশতেহার বা কর্মপরিকল্পনা দেখে তাদের নীতি-আদর্শ ও দর্শন এবং তারা সময়কে কতটা ধারণ করতে পারছে, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই ইস্যুতে বিএনপির সাথে পার্থক্য স্পষ্ট। আবার সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার কথা আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে না থাকলেও আদালতের রায়ের আলোকে তারা এই বিধান বাতিল করেছে; যা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। ফলে একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অন্তত প্রধান দুটি দল যে ইশতেহার ঘোষণা করবে সেখানে তারা এবার কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেবে এবং তাদের মূল স্লোগান কী হবে—সেদিকে দেশবাসীর নজর থাকবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)