ব্রিসবেন টেস্টে ভারতের জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন একঝাঁক তরুণ। রিশভ পান্ট, ওয়াশিংটন সুন্দর, শুভমন গিল- ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের পর এই তরুণদের নিয়ে যেমন বন্দনা চলছে, তেমনি আড়াল থেকে উঠে আসছে আরও একটি নাম, তিনি ভারতের নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটের ‘দ্রোণাচার্য’ রাহুল দ্রাবিড়।
কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান দ্রাবিড় নিজের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে এমন এক পাইপলাইন তৈরি করে দিয়ে চলেছেন দেশের জন্য, যেখান থেকে ভবিষ্যতে ভরসা করার মতো ক্রিকেটার পেতে হাপিত্যেশ করে মরতে হবে না ভারতকে।
পান্ট, ওয়াশিংটন কিংবা গিল- সবগুলো নাম মিলে যায় একপ্রান্তে, বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি বা এনসিএ। ‘দ্য ওয়াল’খ্যাত দ্রাবিড় এখন এই একাডেমির পরিচালকের দায়িত্বে, সঙ্গে আছেন জাতীয় দলের সাবেক পেসার পরশ মহমব্রে।
একাডেমির দায়িত্বে আসার আগে ছয় বছর অনূর্ধ্ব-১৯ ও ভারত ‘এ’ দলের দায়িত্বে ছিলেন দ্রাবিড়। তার প্রথম ব্যাচে ছাত্র ছিলেন রিশভ পান্ট ও ওয়াশিংটন সুন্দর, দ্বিতীয় ব্যাচে ক্রিকেটীয় দীক্ষা নিয়েছেন শুভমন গিল ও পৃথ্বী শ’দের মতো উঠতি তরুণরা।
বর্তমানে এনসিএ’র অধীনেই চলে অনূর্ধ্ব-১৯, ভারত ‘এ’ দলের ক্রিকেটারদের পরিচর্যা। এ প্রোগ্রামে যেসব ক্রিকেটার আছেন, সবাই বয়সে তরুণ। এনসিএ’র লক্ষ্যই হচ্ছে নিবিড় পরিচর্যায় তরুণদের গড়ে তোলা। যেখানে ৩০ ঊর্ধ্ব ক্রিকেটার প্রায় নেই বললেই চলে।
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারত ‘এ’ দল থেকে বিমানবন্দরেই বাদ পড়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সী নোমান ওঝা, তার বদলে দলে ঢোকেন তরুণ সাঞ্জু স্যামসন। দায়িত্ব নিয়েই দ্রাবিড় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এনসিএ হবে ভারতের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ‘একাডেমিয়া’ আর তিনি তার প্লেটো।
এনসিএ’তে তরুণদের জন্য আছে দারুণ প্রযুক্তি, সঙ্গে সবরকম ক্রিকেটীয় সুব্যবস্থা। প্রতি সপ্তাহে অনূর্ধ্ব-১৯ ও ‘এ’ দলের প্রত্যেক ক্রিকেটারের জন্য আলাদা আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করে তা পর্যালোচনা করা হয়।
এর বাইরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) পুলে থাকা ৩০ ক্রিকেটারদের মধ্যে কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এনসিএ’তে। তাতে বড় একটা দলের পেছনে টানা কাজের চাপ থেকে নিস্তার পান দেশটির জাতীয় দলের কোচরা।
সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয় স্কিল বৃদ্ধি, টেকনিক ও ফিটনেসের দিকে। যেমন, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একজন ক্রিকেটার গত সপ্তাহে কী ধরনের শট বেশি খেলেছেন, তার আগের সপ্তাহে এই শট ঠিক কতবার খেলা হয়েছে, শটের জোর কত, শটে বল কতদূরে গিয়েছে, শটের টেকনিক কিংবা অ্যাঙ্গেল, অন্য শট খেলায় সেই ব্যাটসম্যানের কতটা দুর্বলতা আছে, এসব আলাদা আলাদা ভাবে উল্লেখ করা থাকে।
বিশেষ কোনো শটে দুর্বলতা থাকলে সেটা নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা হয় এবং ধরন পাল্টানোর প্রতি জোর দেয়া হয়।
ম্যাচে একজন খেলোয়াড় কী ধরনের পারফরম্যান্স করল, সেটাও আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয়। বেশি বেশি ম্যাচ খেলার চাপ কমাতে আছে ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ ও ‘ডেটাবেজ’। পেসার মোহাম্মদ সিরাজ ও ব্যাটসম্যান মায়াঙ্ক আগারওয়াল ‘এ’ দলের নিয়মিত সদস্য। ঘরোয়া লিগে খেলতে হবে, তাই একাধিক ‘এ’ দল সফরে এ দুজনকে বিশ্রাম দেয়ার ঘটনা আছে।
এনসিএ নিয়ে বিসিসিআইয়ের সাবেক নির্বাচক দেবাং গান্ধী টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলছেন, ‘মূল লক্ষ্য হচ্ছে তরুণদের পরিচর্যা করা। অনেক ক্রিকেটার আছে যাদের জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু আমরা তাদের ‘এ’ দলের সফরে নেই না। কারণ তাদের সম্পর্কে আমরা এরইমধ্যে জানি। যদি এই ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করে, আর জাতীয় দলে জায়গা ফাঁকা থাকে, তাহলে তাদের ঘরোয়া পারফরম্যান্স দিয়েই জাতীয় দলে সুযোগ করে দেয়া হবে।’
নির্বাচকদের নির্বাচন নিয়ে দ্রাবিড় কখনো প্রশ্ন তোলেন না বলেও জানিয়েছেন গান্ধী, ‘দ্রাবিড় আমাদের বিশ্বাস করতো। সে সবসময় নির্বাচকদের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এমনকি যেকোনো সফরে তার অভিমত দেয়ার ক্ষমতা আছে। মূল দলের কোনো প্রয়োজন হলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি এবং পরে সেটা সে বোর্ডের কাছে উত্থাপন করে।’
সবশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে যা হয়েছে সেটা বিসিসিআই, নির্বাচক ও এনসিএ’র পরিশ্রমের মিলিত ফসল। সবশেষ দুই বাজেটে এনসিএ এবং ‘এ’ দলের পেছনে খরচ দ্বিগুণ করা হয়েছে, নির্বাচকরাও চান যতটা সম্ভব বেশি বেশি ক্রিকেটার যেন পরিচর্যা শেষে জাতীয় দলে আসার পথে প্রস্তুত থাকে।
অস্ট্রেলিয়া সফরে এনসিএ তাদের খেলোয়াড় সরবরাহ করে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে। আর সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড় নিজে, বোর্ড-নির্বাচক ও এনসিএ’র মধ্যে যোগসূত্রটা মজবুত হয়েছে এ কিংবদন্তির হাত ধরেই।