ভদ্রলোকের নাম আইনউদ্দিন। বহু বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বইমেলায় পরিচিত হলাম। তিনি দুজন নারীকে নিয়ে বইমেলায় এসেছেন। একজন তার স্ত্রী। আরেকজন কন্যা। স্ত্রীও অবসরপ্রাপ্ত একজন। কন্যা এখন পদস্থ কর্মকর্তা। আইনউদ্দিন তার পরিচয় হিসেবে বললেন, “আমি একজন বীর মুক্তিযাদ্ধা। আরেকটি পরিচয় আছে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার।”
তারপর বিনীত ভঙ্গিতে নিজেকে আড়াল করে স্ত্রীকে সামনে এগিয়ে দিলেন। নিজে মুখে স্ত্রীর নামটি বললেন। জানালেন, এবারের বইমেলায় তার একটি বই এসেছে। বেশ গর্বিত তিনি। আমাকে নয়, চ্যানেল আই এর সরাসরি অনুষ্ঠান উপস্থাপকের কাছে পরিচয়টি পৌঁছে দিতে পেরে তিনি বেশ স্বস্তিবোধ করছেন। পরপরই তিনি কন্যার পরিচয়টি দিলেন আরো গর্বের সঙ্গে। তার কর্মস্থল পদমর্যাদা তুলে ধরার পর বললেন, ওর একটি গল্পগ্রন্থ বের হয়েছে।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন স্বামী ও একজন বাবার জীবনের তৃপ্তির জায়গাটুকু বইমেলায় এসে যেন পাল্টে যায়। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি লেখালেখি করেন না? বললেন, “উনারা লেখালেখি করেন। এটিই আমার জীবনের বড় পাওয়া।”
জীবনকে গভীরভাবে উদযাপনের অনেক নগদ বিষয় রয়েছে। রয়েছে অন্যরকম বিষয়ও। জনাব আইনউদ্দিনকে বেশ কয়েকদিন বইমেলায় দেখেছি। চেহারা বলে, বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। কমও হতে পারে। বইমেলায় তার প্রাণিত চেহারা বলে দেয়, স্ত্রী ও কন্যার লেখক সত্তা তাকে জাগিয়েছে নতুন করে।
বইমেলা থেকে সেদিন আমাকে ফোন করলেন ঈশ্বরদীর প্রত্যন্ত এলাকার এক কৃষক নাম রসুল মিয়া। আমি মাঝে মাঝে তার ফোন পাই শেরে বাংলা নগর সেচ ভবনের ভেতর সপ্তাহে দুদিন বসা ‘কৃষকের বাজার’ থেকে। কিন্তু বইমেলা থেকে তিনি ফোন করলেন, কার্যকারণ মেলাতে পারলাম না। আমি মেলায় ছিলাম না। তাই তার সঙ্গে দেখা হলো না। তবে জানতে পেরেছি বইমেলায় তার আসার কারণ।
তিনি জানিয়েছেন, কৃষকের বাজার থেকে অনেকের মুখেই তিনি শুনেছেন ঢাকা বইমেলার কথা। মনে হয়েছে, এই মেলায় না আসলে তিনি জীবনের বড় কিছু হারাবেন। তাই বইমেলা তিনি দেখেছেন। ঘুরেছেন। বই কেনেন নি। কারণ, বই কেনার চেয়ে বইয়ের রাজ্যে ঘুরে তিনি যে আনন্দ পেয়েছেন, তা অনেক দামী। ইচ্ছে আছে আগামী বছর থেকে বইমেলায় আসবেন তিনি। প্রতিবছরের এটি হবে অপরিহার্য কাজ।
বললাম, জীবনের অনেক গল্প আছে না? সেগুলো লিখতে পারেন। বললেন, লিখতে পারি না। বললাম, মনের ভেতর কথা তো আছে। এগুলো শুধু বলবেন। লেখা হয়ে যাবে। পড়তে পারা একটি কারিগরী যোগ্যতা। লিখতে পারাও একটি কারিগরী যোগ্যতা। কিন্তু ভেতরের কথাগুলো প্রকৃতিক শক্তি। এই শক্তি যেকোনো কারিগরী যোগ্যতার ওপরে। এগুলো সূর্যের আলোর মতো। এর উত্তাপ থাকে আলোও থাকে। রসুল মিয়া বললেন, আমি বই লিখবো। আমার মনে অনেক গল্প। এই সব লিখে দেব।