আমি তখন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে সাপ্তাহিক ২০০০-এ কাজ করি। কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নেয়ার ভার এসে পড়ল আমার ওপর। তার সাক্ষাৎকার নিতে হবে জেনে ভালোই লাগল আমার। তিনি তখন থাকেন মগবাজারের মোড়ে। নানান হিসেব নিকেশ করে এক বিকেল আর সন্ধ্যের মাঝামাঝি সময়ে গেলাম তার কাছে। চোখে কম দেখেন, কানেও খুব একটা ভালো শোনেন তাও নয় তবে কথাবার্তার মধ্যে তিনি যে এখনো এক ধরনের মুন্সিয়ানা রাখেন বা দেখান সেটা বুঝি। প্রশ্ন না বুঝলে বা শুনলে কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলতে হয়।
নানা বিষয়ে নানান কিসিমের কথাবার্তা হলো তার সঙ্গে। আমরা তার ড্রইং রুমে বসেছি। কিছুক্ষণ পর পর ঘরের ভেতর থেকে অপরিচিত মুখ উঁকিঝুঁকি মেরে আমাদের নজরবন্দী করছেন। বোঝা গেল আল মাহমুদকে তার ঘরের মানুষ দেখে দেখে রাখেন।
একথা সেকথার পর তাকে জীবনভর তার রাজনৈতিক আদর্শ, বিশ্বাসের বদল আর ‘এদিক-সেদিক’ গোত্তা খাওয়ার নিরন্তর প্রবণতার প্রসঙ্গ তুললাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। মুখে তার হাল্কা হাসির প্রলেপ,
‘এতক্ষণ তো ভালোই ছিলাম। এবার আমাকে ঘায়েল করার পালা এসেছে, তাই না?’
তিনি তখনো মুখে সেই হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেছেন।
মাহমুদ ভাই, জীবনে এই যে এতবার আদর্শ আর বিশ্বাসের পরিবর্তন করলেন এর কি ব্যাখ্যা দেবেন?’
আমার প্রশ্নে তিনি অনেকক্ষণ নীরব হয়ে থাকলেন। মাথা হেলালেন। আমার দিকে তাকিয়েও রইলেন। শেষে বললেন, ‘শোন, দোষে-গুণে আমি আল মাহমুদ। জীবিত কবিদের মধ্যে একমাত্র আমিই প্রশংসার চেয়ে নিজের নিন্দা শুনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যখন ভালোবেসে কেউ আমাকে তুচ্ছজ্ঞান করে, আমার সাহিত্যের অর্জনকে ধূলিসাৎ করে- তখন সত্যি সত্যি আমার ভালোই লাগে।’
‘বেঁচে থাকার জন্য আপনার ক্রমাগতভাবে ডিগবাজি খাওয়ার প্রবণতা আপনার ব্যক্তিজীবন এবং একই সঙ্গে সাহিত্যে আপনাকে মোটা দাগে বিতর্কিত করেছে। আপনি বঙ্গবন্ধুর উদারতার পরশ পেয়েছেন, পরবর্তীতে তার কল্যাণে ভালো থেকেছেন আবার তার মৃত্যুর পর তাকে অস্বীকার করে রাতারাতি জামায়াত-শিবিরে আস্তানাও গেড়েছেন-সব মিলিয়ে আপনি ডিগবাজির খেলায় নেমে নিজেকে বিতর্কিত করে নিজের অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন যা ভবিষ্যৎকালে আপনার মূল্যায়নে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সাহিত্য সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?
আমার প্রশ্নে আল মাহমুদ সম্ভবত রেগে গেছেন। যে দিনকাল পরেছে তাতে করে আজকাল তো মানুষ এমনি এমনি নিজের ওপর তো বটেই অন্যের ওপরেও রেগে যায়। আশির দশক থেকে আল মাহমুদের রাজনৈতিক আদর্শ, নীতির বিচ্যুতি কিংবা স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের সঙ্গে অহেতুক মাখামাখি তাকে এক ধরনের এক ঘরে থাকার মতো অবস্থান তৈরি করে দেয়। সাহিত্যে বিরোধী শিবিরের লোকজন তার এই অবস্থানকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে তিনি সব মহলে নিন্দিত ও বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাসে কি বিষয় বৈচিত্র্য কি চমক কি গাঁথুনির ধারে কাছে ঘেঁষতে না পেরে এক ধরণের লেখকরা শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক বিচ্যুতির বিষয়টিকে চিহ্নিত করে সমবেতভাবে প্রথমে সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পরে ‘এক ঘরে’ করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে। ফলে গত দু তিন দশকে এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েছে এবং এক সময় তাকে সাহিত্যে প্রায় একরকম এক ঘরে করে ফেলা হয়।
অনেক ক্ষণ চুপ থেকে আল মাহমুদ ধীর গলায় আমাকে বললেন, শোনো তোমাকে একটা কথা বলি, আমি আল মাহমুদ যে কটা দিন বেঁচে আছি সে কটা দিন আমার এক ধরনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে অস্বীকার করে, আমার কবিতা- গল্পের ভুলভাল ব্যাখ্যা করে এক ধরণের আত্ম বিধ্বংসী খেলায় মেতে থাকবে। এদের জন্য আমার আফসোস হয়- এছাড়া আমার করার আর কিছুই নেই। এরা জানে না একজন জীবিত আল মাহমুদের চেয়ে একজন মৃত আল মাহমুদ অনেক বেশি শক্তিশালী।
আমি আমার প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো জবাব না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, আমি জানতে চাইছিলাম আপনি আপনার জীবনে এত অবস্থান পরিবর্তন করলেন কেন?
এবার তিনি তার সারা মুখমণ্ডলে কেমন এক ধরণের হাসিমাখা আভা ছড়িয়ে দিলেন, শোনো বাংলা সাহিত্যে কে টিকে থাকবে কে অমর হবে আর কে পিয়ন–কেরানি হয়ে থেকে যাবে আমি মারা যাবার পর তোমরা আমাকে কিভাবে মূল্যায়ন কিংবা ব্যাখ্যা করবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই কারণ আমি জানি পড়তে পড়তে আমি নড়তে শিখেছি।
শোনো তোমাকে একটা কথা বলি, আমি আল মাহমুদ যে কটা দিন বেঁচে আছি সে কটা দিন আমার এক ধরনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে অস্বীকার করে, আমার কবিতা- গল্পের ভুলভাল ব্যাখ্যা করে, এক ধরণের আত্ম বিধ্বংসী খেলায় মেতে থাকবে। এদের জন্য আমার আফসোস হয়- এছাড়া আমার করার আর কিছুই নেই। এরা জানে না একজন জীবিত আল মাহমুদের চেয়ে একজন মৃত আল মাহমুদ অনেক বেশি শক্তিশালী।
সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাসে কি বিষয় বৈচিত্র্য কি চমক কি গাঁথুনির ধারে কাছে ঘেঁষতে না পেরে এক ধরণের লেখকরা শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক বিচ্যুতির বিষয়টিকে চিহ্নিত করে সমবেতভাবে প্রথমে সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পরে ‘এক ঘরে’ করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে। ফলে গত দু তিন দশকে এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েছে এবং এক সময় তাকে সাহিত্যে প্রায় একরকম এক ঘরে করে ফেলা হয়।