Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

‘এখনকার ভালোবাসা কেমন যেন আসে আর যায়!’

‘ইচ্ছে করেই একদিন বলেছিলাম, না বিয়ে করতে পারবনা এখন! তার প্রতিক্রিয়া জানতে এমনটি বলেছিলাম। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ঠিক আছে আমি আর কিছু বলবনা। তবে আমি আর ছবি বানাবনা। এই দেশ, দেশের মানুষের আমাকে প্রয়োজন আছে। আর আমাকে বাঁচাতে চাইলে তোমাকে আমার প্রয়োজন। কতটা গভীর ভালোবাসার জায়গা থেকে তিনি এ কথা বলেছিলেন তা ভাবলেই আজও অবাক হই। কান্না পায়।’

প্রায় ৫০ বছর আগের কথোপকথন হৃদয়ের গহীন ভেতর থেকে তুলে নিয়ে আসলেন তিনি। টেলিফোনের এপার থেকে হৃদয় গহীনের সেই স্মৃতিমানিক্য এবং উপলব্ধির ‘জীবন থেকে নেয়া’র। সিনেমার সংলাপ মনে করে বলেননি তিনি, কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। বলেছেন একান্ত ব্যক্তি জীবন থেকে নেয়া কথামালা। যার সঙ্গে এই কথোপকথন। তিনি জীবন থেকে নেয়া’র নির্মাতা জহির রায়হান। তার বন্ধু-প্রেমিক-অনুপ্রেরণা দাতা-স্বামী। অথচ মাত্র ৩ বছরের সংসার জীবন।

ভালোবাসার কথা কি মুখ ফুটে বলেছিলেন কখনো? অথবা কীভাবে প্রকাশ করেছিলেন? ফোনের এপার থেকে ঠিক বোঝা যায় তিনি ডুবে যাচ্ছেন স্মৃতিতে। ‘বেহুলা’ সুচন্দার কণ্ঠস্বরে স্মৃতিমেদুরতা। বলে চলেন ওপার হতে, ‘মুখে যতটা না বলতেন তার চেয়ে চোখে কথা বলতেন। তখন আমার বয়স ১৮ বা ১৯। প্রেম পড়ার বয়সই তো। তিনি হয়ত ক্যামেরায় লুক থ্রু করছেন। শট নেবেন। মনিটর হচ্ছে।  মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকাতেন যা আমি পড়ে নিতে পারতাম। বুঝতে পারতাম তিনি কি বলতে চাইছেন।’

‘এসময়ের ভালোবাসা দিবস পালন বিষয়ে অভিমত কী? প্রশ্নে ‘তিন কন্যা’ প্রযোজক বলেন, ‘খারাপ কি! যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি নির্দিষ্ট দিনকে ভালোবাসার ভাবিনা। তবে এই প্রকাশভঙ্গী খারাপও লাগেনা। বসন্ত হচ্ছে ঋতুরাজ। এত রঙে রাঙানো। এখন যে ছেলেমেয়েরা ঋতুর সঙ্গে মিলিয়ে সাজে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। তা দেখতে খুব ভালো লাগে। চোখ ঝলসে যায়। তবে কোথায় যেন একটা কমতি চোখে পড়েই। এখনকার ভালোবাসা কেমন যেন আসে আর যায়!’

‘আপনাদের ভালোবাসার গল্পটা কেমন ছিল? জহির রায়হান কি কখনও ফুল দিয়েছেন?’ প্রশ্নটার জন্য ওপাশে অনেকটা যেন তৈরি ছিলেন ‘আনোয়ারা’র নায়িকা। বলেন, ‘তখন তো এতটা বুঝতামনা। এমন কোন নির্ধারিত ভালোবাসার দিনও ছিল না। ব্যক্তিগতভাবেই খোঁপায় একটা ফুল রাখতাম সেসময়েই। আমি যশোরের মেয়ে। ফুলের জন্য বিখ্যাত যশোর। বাবার একটা শখ ছিল। বাগান করা। প্রায় প্রতি বাড়িতে আঙ্গিনা থাকত। আমাদেরও ছিল। গাঁদা ফুল খুব বেশি থাকত। বাবার সঙ্গে বাগান করায় সাহায্য করতাম ছোটবেলা থেকে। তো বাগানের ফুল প্রায় নাই হয়ে যেত। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরের মধ্যে। সকালে  উঠে ফুল না দেখে সে কি কান্না থাকত আমার। জহির আমার খোঁপার ফুল খুব পছন্দ করত। পরে বুঝেছি। কিন্তু বলতনা সেভাবে। খোঁপায় নিয়মিত বেলি ফুলের মালা এবং রজনীগন্ধার গোছা  থাকত। কখনও বলতেন না কিছু। কিন্তু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতেন। তার সেই চাহনি অন্তরে চিরকালের জন্য গেঁথে রয়েছে। থাকবে আমৃত্যু।’

একটু থামেন সুচন্দা। তারপর মনে পড়ার মত করে উচ্চস্বরে বলেন, ‘তিনি খুব ভালো গাড়ি চালাতেন। জোরে চালাতেন। তার নিজস্ব মরিস গাড়ি নিয়ে সুযোগ পেলেই বের হতেন। সে গাড়িতে অনেকে থাকলেও পাশের সিটে আমি থাকতাম। জোরে চালাতে চালাতে হঠাৎই ডানে বাঁক নিতেন। আমি তাল সামলাতে না পেরে তার গায়ে পড়তাম। আমি বুঝতাম তিনি কেন ডানে মোড় নিলেন। একটু আলতো স্পর্শের জন্য পেছনের যারা থাকত তারা বলত, একটু আস্তে চালালেই তো হয়। আমি বলতাম, আমার বেশ লাগছে। ভয় লাগছে নাতো। সে সময়ের একটু স্পর্শতেই ভালোবাসার বিশাল ব্যাপ্তিময় অনুভূতি তৈরি হত। আমার কাছে ভালোবাসা এখনও গাছের বেড়ে ওঠার মত। ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠে।’

বলে চলেন সুচন্দা, ‘ব্যক্তি জহির রায়হানকে যতটা ভালবেসেছি তার চাইতে বেশি ভালবেসেছি তার লেখা, গুণাবলী, প্রতিভা এবং কাজ। তিনি ভীষণ রোমান্টিক ছিলেন, কাজ প্রেমিক ছিলেন। তবে সংসারের খোঁজ রাখতেন না। বলা চলে রাখতে পারতেন না নিরন্তর সৃষ্টিশীলতার তাগিদে। আমার কাছে তিনি সেই চির রোমান্টিক ভালোবাসার মানুষ হয়ে আজও আছেন।

কথোপকথনে উঠে আসে জীবন থেকে নেয়া’র শুটিং প্রসঙ্গ। ‘তখন তো সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে?’ তিনি উত্তর দেন, ‘ঠিক সবে মাত্র না। যখন শুটিং করি ‘জীবন থেকে নেয়া’র তখন তপু আমার গর্ভে। আমি তপুকে এখনও বলি তুই তো অসাধারণ ইতিহাসের সাক্ষী।’ স্মৃতি যেন পেয়ে বসে সুচন্দাকে। তুলে ধরেন শহীদ মিনারের প্রভাতফেরীতে সরাসরি শুটিংয়ের কথা। বলেন, ‘প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি আসে। আর আমার দিনটির কথা মনে পড়ে। ৬৭/৬৮ হবে। আমাদের দিলু রোডের বাসায় রোজী ভাবী, আনোয়ার হোসেন এবং রাজ্জাক ভাই ছিলেন। সারারাত আড্ডা দিয়েছি আমরা। তারপর গাড়িতে করে শহীদ মিনার থেকে একটু সামনে থামি। ক্যামেরা সেট করে যখন তিনি ডাক দেন তারপর আমরা যাই। গেন্ডারিয়া থেকে আসা একটি মিছিলের সঙ্গে আমরা জুড়ে যাই। গেন্ডারিয়ার প্রতি তার আলাদা ভালোবাসা ছিল। শত হলেও শ্বশুরবাড়ির এলাকা।’

ছেলে বিপুল রায়হান কোলে জহির রায়হান

তিনি উত্তর দিতে চাইলে দিতে পারেন বা এড়িয়ে যেতে পারেন বিনা দ্বিধায়-এমন সুযোগ রেখে সুচন্দার দিকে প্রশ্ন ছোটে জহির রায়হানের প্রথম পরিবারের দুই ছেলে বিপুল রায়হান এবং অনল রায়হান বিষয়ে। আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘উত্তর দেব না কেন! আমার অপু এবং তপুর সঙ্গে তাদের কী যে হরিহর আত্মা সম্পর্ক তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। আমার সন্তানদের সব সময় বলেছি তারা তোমাদের ভাই। তোমার বাবার সন্তান। কোনদিন যেন তারা অসম্মানিত না হয়।  তারা আমাকেও ভীষণ সম্মান করে। সুমিতা আপার সঙ্গেও আমার কখনও খারাপ সম্পর্ক ছিলনা। প্রথম দিকে কিছু দুরত্ব হয়ত ছিল। হ্যাঁ শিল্পী জীবনের নানা বাঁক থাকে। সেটাই তো স্বাভাবিক। হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে সেসব বাঁক বদলে ফেলা যায়।’

Exit mobile version