সরকারি হিসাব মতে আমাদের দেশে শিক্ষা ও শিক্ষিতের হার বেড়েছে। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, এমনকি নিজের বাড়ির উপর বা নীচতলায় স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি আক্ষরিক অর্থে এটা প্রমাণও করে। তবে কথা হলো আমরা কী সত্যি শিক্ষিত হচ্ছি? নাকি কুশিক্ষার গহবরে নিমজ্জিত হচ্ছি দিন দিন। আমরা যদি সুশিক্ষিত জাতি হই তাহলে আমাদের মানসিকতা এত নিম্নমানের হবে কেন?
গত দু’দিন অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমুর বিয়ে নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় দেখলাম তাতে অন্তত: আমার মনে হয় না আমাদের এই শিক্ষায় কোন মৌলিক বা সামাজিক মূল্যবোধ আছে।
সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় আদি রীতিগুলোর অন্যতম একটি রীতি বিয়ে। এই রীতির মাধ্যমে একটা ছেলে বা মেয়ে অন্য একটা ছেলে বা মেয়ের সাথে নতুন একটা পরিবার গড়ে তোলার প্রথম ধাপে পা দেয়। আর তাই আমরা অন্তত: এক্ষেত্রে এমন একজন সঙ্গী খুঁজি যার ভেতরের মানুষটা হবে জীবনের সমস্ত আনন্দ বেদনা সুখ দু:খের অংশিদার। যে কখনো তার বন্ধু, কখনো বা অভিভাবক হয়ে সারা জীবন আগলে রাখার ক্ষমতা রাখে। যদি তার সেই সঙ্গীর ভেতরের মানুষটা তা না হয় তাহলে তার সাথে বসবাস করাই তো সম্ভব না, জীবন কাটানো তো দূরের কথা।
বলছিলাম সুমাইয়া শিমুর কথা। শিমুর বর কালো বলে যেন চারদিকে একরকম ছি! ছি! রব পড়ে গেলো। অনেকেরই মন্তব্য: শিমু টাকার জন্যে ওই কালো মহিষটাকে (তাদের ভাষ্য) বিয়ে করেছে। তাদের কারো কাছেই আমি ছেলেটার গুণাবলি নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো তারা এতটাই মূর্খ যে কথাগুলো বলার সময় একবারও ভাবে না যে এতে তাদের নিজেদের চাওয়া এবং রুচির প্রকাশ ঘটছে। মানে তারাও টাকার কারণে ভারতের যুবরাজ নামের সেই ষাঁড়টাকে বিয়ে করতে রাজি। কেননা ওই ষাঁড়ের দাম ৯ কোটি রুপিতে উঠলেও মালিক তাকে বিক্রি করেনি। ওইটাকে বিয়ে করলে টাকার একটা নিশ্চয়তা ওরা পাবে।
মানবিক ও সামজিক মূল্যবোধহীন মানুষদের কাছ থেকে শুধু সুমাইয়া শিমু এই জাতীয় আক্রমণের শিকার নন। একজন সাংবদিককে চিনি। তিনি তার বিয়ের নিমন্ত্রণ জানানোর পর অনেকের মাঝে হাসির রোল পড়ে গেলো। শুভ কামনাতো দূরের কথা, তাদের মন্তব্য: ‘এই কালিকে কে বিয়ে করতেছে’!
তার বর বর্ণবাদ বিষয়ে বিদেশের একটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন শুনে কেউ কেউ বলে উঠলেন, কালিতো বাজিমাত করে দিলো, দেখিয়ে দিল সবাইকে। আবার কেউ কেউ বললো, সাবজেক্টের এক্সপেরিমন্ট করতেই হয়তো ওকে বিয়ে করছে সেই ছেলে। মন্তব্যগুলোই বলে কতটা জঘন্য আর হীনমন্যতায় ভুগলে মানুষ এ ধরণের কথা বলতে পারে!
কিরকম মানসিকতার মানুষের মাঝে আমাদের বসবাস ভাবতেই ঘৃণা জন্মায়। ফর্সা মেয়েরা কেমন ছেলে বিয়ে করবে বা ফর্সা ছেলেরা কেমন মেয়ে বিয়ে করবে, এর কি কোন বাধ্যবাধকতা আছে? যদি নাই থাকে তাহলে কেন আমাদের মাথা ব্যাথা? এমন কোন আইনি নিয়ম আছে যে সেলিব্রেটিরা কালো পুরুষ বিয়ে করতে পারবেন না? তাহলে সুমাইয়া শিমুর বিয়ে নিয়ে কেন এত গাত্রদাহ। নাকি আঙ্গুর ফল টক এর মত কিছু বিষয় আছে তাদের ভেতর।
বিয়ে ডিভোর্স এসবতো সম্পূর্ণ যার যার নিজস্ব ব্যাপার। নিজেদের ভালো লাগা না লাগার উপর নির্ভর করে। একজন সুন্দরী নিউজ প্রেজেন্টারের বিয়ে হয়েছে বছরখানেক আগে। তার বর কালো এবং মোটা। তাকে নিয়েও এই জাতীয় মন্তব্য শুনেছি লোকজনের কাছে। বলতে শুনেছি, এই সুন্দরী মেয়েটা ওই লোকটাকে নিয়ে সমাজে চলাফেরা করবে কিভাবে?
অথচ এই জাতীয় মন্তব্য করা মানুষগুলোই সমাজে শিক্ষিতের মুখোশ নিয়ে দিব্যি মাথা উঁচু করে চলছে। এরা এতটাই বর্ণচোরা যে এদের দেখে চেনা যায় না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)