কিছুদিন পরেই আসছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। যে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বাঙালিকে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল একটি ভাষা, যার নাম বাংলা ভাষা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই একমাত্র ঘটনা যে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য এত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা মাতৃভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হই। বাকি ১১ মাস ঘুম পাড়িয়ে রাখি মাতৃভাষার চেতনাকে। ভুলে যাই আমারা আমাদের অতীতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মৃতিকে।
‘চিঠিটা তার পকেটে ছিল, ছেড়া আর রক্তে ভেজা।’ বিখ্যাত এই কবিতার লাইন দুটি কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর । মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সন্তান রাজ পথে নেমেছে আন্দোলনে। মা সন্তানকে চিঠি দিয়েছে বাড়ি ফেরার জন্য। কিন্তু সেই চিঠি বুক পকেটে নিয়ে ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে ভাষা সংগ্রামীরা। শহীদ হওয়ার পর সন্তানের পকেটে পাওয়া যায় মায়ের চিঠি। লাল রক্তে ভিজে ছিঁড়ে গেছে। কেমন দৃশ্য এটি? একবার কল্পনা করুন তো? আমাদের ভাষাটা এমনি এমনিই আসেনি। এরকম নানা দুঃসহ ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের ভাষা। কোনকিছু উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া খুবই সহজ কিন্তু তার অবিকৃত রূপ ঐতিহ্য ধরে রাখা কষ্টের। আমারা হারাতে বসছি আমাদের প্রকৃত বাংলা ভাষাকে। নানা সময় বিকৃত ভাবে বাংলা শব্দ উচ্চারণ করি। বাংলা ভাষার মধ্যে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করছি যেটির অর্থই পাল্টে দিচ্ছি। বিশেষ করে আমরা যারা তরুণ প্রজন্ম তারাই এই কাজ গুলো জেনে অথবা না জেনে করছি। তরুণরা কি ভয়ানক অন্যায় কাজ গুলো করছি তা আজকে দেখানোর চেষ্টা করবো।
বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় সেটা হলো, কম সময়ে বেশি কাজ করা। অল্প সময়ে বেশি বুঝিয়ে দেয়া। তাই সবাই সংক্ষিপ্ত বা শর্টকাট রাস্তা খুঁজতে থাকি আমরা। সেটা যদি কথায় ও লেখায় হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। আর এই শর্টকাট করতে গিয়েই তৈরি হয় বিকৃত রূপ। তরুণরা বাবাকে বলছে, ‘বাবা এত প্যারা দিও নাতো!’‘প্যারা’ শব্দের অর্থ বুঝতে না পেরে বাবা-মা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। এই শব্দটা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে অদ্ভুত ঠেকে। কিন্তু প্যারা শব্দের অর্থ বাংলা/ইংরেজি অভিধানে পাওয়া যায়- একাধিক বাক্যের রচিত গদ্যের অংশ।
ভাই অথবা বন্ধুকে বলি, ‘হাই ব্রো’। ‘ভাই’ হয়ে যায় ‘ব্রো’! রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ইংরেজিতে‘জি’, ‘ডি’, ‘এন’ আর ‘এইট’ লিখে সামাজিক মাধ্যমে চার অক্ষরে হয়ে যায় ‘গুড নাইট’ স্ট্যাটাস। কত সহজে মনের ভাব প্রকাশ করছি! তাই না? আর বাংলায়, তোমরা থেকে ‘তোম্রা, তারপর ‘ব্যাপক’, ‘অস্থির’ ‘বিনুদুন’,‘ক্যারে’, ‘লুল’ ইত্যাদি! এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে।
অনেকে বলতে পারেন কথা বুঝলেই তো হলো, যেমনই হোক না! কিন্তু যখন সবাই একসঙ্গে এমন রূপের ব্যবহার শুরু করেছেন,তখনই তা উদ্বেগ সৃষ্টি করে। নিজের ভাষার বিকৃতি নয় কি এটি? এভাবে নানা বাংলা শব্দ বিকৃতি ঘটছে অহরহ। যা বাংলা ভাষার জন্য হুমকি স্বরূপ।
সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নিচের ক্লাসের ছেলে মেয়েরা এসব পরীক্ষার খাতায় লিখছে। আমি বলবো এদের কী দোষ। তারা যা শিখছে, বলছে তাই তো পরীক্ষার খাতায় লেখবে। এটাইতো স্বাভাবিক। তাই যতো দ্রুত সম্ভব এসব পরিহার করা উচিত। কথা বলুন সম্পূর্ণ বাংলা ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষায়। আঞ্চলিকতার ব্যবহার থাকবে কিন্তু বাংলা ভাষার বিকৃতি কেন? বিষয়টা যেন অশনি সংকেত। এক্ষেত্রে সবারই সচেতন হওয়া দরকার। বন্ধ করতে হবে ভাষার বল্গাহীনব্যবহার। আমাদের উচিত ছোট ভাই-বোন,বন্ধুবান্ধবদেরকে এই ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন করা।
ভাষা পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তন বা আধুনিকতার নামে ভাষার বিকৃতি কখনোই কাম্য নয়। পরিবর্তন যেমনই হোক, ভাষার মাধুর্য সৌন্দর্য ও বোধগম্যতা রক্ষা করা জরুরি। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে।
একটি প্রশ্ন প্রায়শই মনে জাগে, এই শুদ্ধ ভাষাকে কতটুকু বজায় রাখছি আমরা বর্তমান প্রজন্মর তরুণরা । আমাদের মতো তরুণদের মধ্যে যে বাংলা ভাষার চর্চা হয়, তাকে বাংলার পরিবর্তিত রূপ বললে বোধ হয় অবিচার হবে না। তাই তো একে বলা হচ্ছে বাংলার বিকৃত রূপ। চলছে বিকৃত ভাষার চর্চা। স্কুল, কলেজপড়ুয়া, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরাও এ ভাষার ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছেন। যা চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশক পরে ‘প্রমিত বাংলা ভাষা’ জাদুঘরে ঠাঁই পাবে। এমনটাই মনে করছি।
বাংলা শব্দের সঙ্গে ইংরেজি শব্দের সংমিশ্রণও বেশ লক্ষণীয় এ সময়ে। কথা বলার সময় অর্ধেক বাংলা বা বাংলা ইংরেজি মিশ্র ভাষা কথা বলতে দেখা যায় প্রায়ই। মাঝে মাঝে ইংরেজি কয়েকটা শব্দ না বললে যেন স্মার্টনেস কমে যায়। এমন অবস্থা । তরুণদের প্রতি একটি অনুরোধ থাকবে যদি বাংলায় কথা বলেন তাহলে বাংলা বলুন। ইংরেজিতে বললে ইংরেজিতে। বাংলা ইংরেজির মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে অপমান করবেন না।
ফেসবুকীয় অভিধানে যুক্ত হয়েছে ‘জোস’,‘অস্থির’, ‘চরম’ ‘কুল’ ‘অসাম’ ‘রকস’ এসব শব্দ। বাংলার ভাষার এ কী অবস্থা? বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় এখন বাংলা ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু ভার্চুয়াল জগত থেকে যেন ‘ছ’ নামের বর্ণটি হারাতে বসেছে। ‘বলছে’ হচ্ছে ‘বলসে’, ‘খাচ্ছে’-কে ‘খাইতাসে’, ‘আসছে’-কে ‘আইসে’, ‘যাচ্ছে’-কে ‘যাইতাসে’। এরপর রয়েছে শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ করতে গিয়ে বিকৃতি। ‘মন চায়’ লেখা হয় ‘মুঞ্চায়’। পাত্তা না দিতে চাইলে মনের ভাব প্রকাশ করেন ‘বেইল নাই’, ‘গুনলাম না’ কিংবা ‘অফ যা’ শব্দগুলো দিয়ে।
বাংলা ভাষার একটি বিশেষত্ব হলো, সকল ধ্বনিই প্রকাশে সক্ষম বাংলা বর্ণমালা আছে। যেটি পৃথিবীর প্রায় ভাষায়ই নেই। তারপরও আমরা কিছু শব্দ ব্যবহার করি। যার কোন অর্থ অভিধানে পাওয়া যায় না। তবে বিকৃতভাবে ব্যবহার করতে করতে হয়তো একসময় বাংলা একাডেমি অভিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হবে। যেমন কিছু শব্দ ‘আজিব’, ‘ফালতু’,‘বেইল নাই’। এ ধরনের কিছু শব্দ কথাবলার সময় বলে থাকি।
১৯৫২ সালের ইতিহাসকে, মাতৃভাষার জন্য রক্তের বিনিময়ে করা সংগ্রামকে। তখন তা বাংলা ভাষার রক্তাক্ত ইতিহাসের তাৎপর্যকে ম্লান করে দেয়। যে তরুণেরা বুলেট বুকে নিয়ে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন,তাদের অবদান আর ত্যাগের প্রতি সম্মান রেখে হলেও আসুন আমরা সচেতন হই ভাষা-বিকৃতির বিরুদ্ধে। তা হোক এখন থেকেই!
তাই কবির ভাষা দিয়েই শেষ করতে চাই- ‘মাগো ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে/ তোমার কোলে শুয়ে, গান শুনতে দিবে না। বলো মা তাই কি হয়? তাইতো আমার দেরী হচ্ছে। তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে, তবেই না বাড়ি ফিরবো। লক্ষ্মী মা রাগ করো না, মাত্রতো আর কটা দিন বাকি।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)