মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এখন টানটান উত্তেজনা। একদিকে সৌদি আরব, আরেকদিকে ইরান, দুইদিকে দুইজন গুটি চালছে। সৌদি আরবকে হাওয়া দিচ্ছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বে ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছে লেবানন ও ইয়েমেন। কাতারও ভুক্তভোগী। তবে সে পরোক্ষভাবে আক্রান্ত।
মধ্যপ্রাচ্য সংকট নতুন মোড় নিয়েছে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির আকস্মিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণায়। গত ৪ নভেম্বর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি পদত্যাগের কথা ঘোষণা করে বলেন, প্রাণ হারানোর ভয়ের মধ্যে আছেন তিনি। হারিরি লেবাননের শিয়া দল হিজবুল্লাহ এবং ইরানের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ২০০৫ সালে তার পিতা রফিক হারিরিকে হত্যার সময় লেবাননের যে পরিস্থিতি ছিল, লেবাননে এখন সেরকম অবস্থা বিরাজ করছে।
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অস্থির এক সময়ে যেভাবে সাদ হারিরি তার পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন, তা সবাইকে বেশ বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে। লেবাননের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে এই পদত্যাগ আরও ঘোলাটে করে তুলেছে। তিনি ইরানের কড়া সমালোচনা করে বলেন, এমন কোনো জায়গা পৃথিবীতে নেই, যেখানে ইরান নাক গলায়নি, ভীতি ছড়ায়নি এবং ধ্বংস ডেকে আনেনি।
সাদ হারিরি’র বাবা রফিক হারিরিও ছিলেন লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ২০০৫ সালে তাকে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পেছনে সিরিয়া এবং ইরানের হাত আছে বলে সন্দেহ করা হয়।
সাদ হারিরি মাত্র গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে তিনি সৌদি আরব সফর করছিলেন। তার ওপর সৌদি আরবের যথেষ্ট প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের তীব্র দ্বন্দ্ব চলছে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। আর সেই সৌদি রাজধানী থেকেই সাদ হারিরি তার পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেন।
লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে আটক রেখে এবং তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে সৌদি আরব লেবাননের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, হারিরি এখন সৌদি আরবে কারাবন্দী এবং নিজের দেশে ফিরতে পারছেন না। সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে মধ্যে বিভেদের বীজ বোনার চেষ্টা এবং একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করানোয় রিয়াদের ভূমিকাকে দায়ী করেন নাসরুল্লাহ।
গত সপ্তাহে সৌদি আরবের এক মন্ত্রী ‘লেবানন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে’ বলে অভিযোগ করেছিলেন। নাসরুল্লাহর বক্তব্যকে তার পাল্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। লেবাননে সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্য সৌদি আরব ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দাবি করে নাসরুল্লাহ বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে কোটি কোটি ডলার খরচ করতে প্রস্তুত রয়েছে সৌদি আরব। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাতে সৌদি আরব লেবাননকে ধ্বংস করতে চায়।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি কেন রিয়াদে বসে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন এবং কেনইবা ইরানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন সেটাই এখন সবার প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, রিয়াদে সাদ হারিরির এ ঘোষণাকে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সৌদি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির মূল হোতা সৌদি আরব ইরানের বিরুদ্ধে নতুন খেলা শুরুর পায়তারা করছে।
ইরানপন্থিরা মনে করছেন, ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ লেবানন সরকারের একটি অংশ এবং সংসদে হিজবুল্লাহর প্রতিনিধিদের অবস্থান দুর্বল করাই প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির পদত্যাগের উদ্দেশ্য। তাদের মতে, লেবাননকে রক্ষায় ইরানের প্রচেষ্টা ও সমর্থনের কারণে সৌদি আরব প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। আর সে কারণে নতুন করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও উত্তেজনা সৃষ্টির দায় ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে রিয়াদ।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়ায় চলমান প্রতিরোধ যুদ্ধ অত্যন্ত স্পর্শকাতর অবস্থানে এসে ঠেকেছে এবং তাকফিরি দায়েশ সন্ত্রাসীদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। এ অবস্থা আমেরিকা, ইসরাইল ও সৌদি আরব কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এ কারণে তারা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ শক্তিগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
এ পরিস্থিতিতে লেবানন নতুন করে রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়তে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
হারিরির পদত্যাগ লেবাননের ইরান সমর্থিত শিয়া ও সৌদি আরব সমর্থিত সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকে মুখোমুখি অবস্থায়ও নিয়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানকে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে সৌদি আরব। সিরিয়া, ইয়েমেনসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলা নানান সংঘাতেও একে অপরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এ দুটি রাষ্ট্র। লেবাননকে ঘিরে নতুন সংকট পরিস্থিতিকে আরো সংঘাতময় করে তুলতে পারে। আঞ্চলিক শক্তি শিয়া প্রধান ইরান ও সুন্নি প্রধান সৌদি আরবের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘূর্ণাবর্তে লেবানন যুদ্ধপরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে-আশঙ্কায় বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মধ্যপ্রচ্যের মূল দ্বন্দ্বটা হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরানের কর্তৃত্ব, প্রভাব বা ক্ষমতা সম্প্রসারণের দ্বন্দ্ব। সৌদি আরব তার সীমান্তের বাইরে এবং তার সীমানার ভিতরে যা কিছু করছে তা হচ্ছে ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য। আর এর পেছনে প্রধান দুই মুসলিম গ্রুপ সুন্নী ও শিয়ার দ্বন্দ্ব। সৌদি আরবে সুন্নী জনগোষ্ঠীর প্রধান্য, আর ইরানে রয়েছে শিয়াদের সংখ্যাধিক্য।
সৌদিরা বিশ্বাস করেন যে সৌদি আরবের সুন্নী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইরানিরা অসন্তোষ ও সক্রিয়তা জাগিয়ে তুলেছে। এটা অনেকটাই এখন সন্দে-বাতিকগ্রস্ত রোগীর স্তরে পৌঁছেছে। সৌদি আরবের মক্কা, যা মুসলমানদের জন্য পবিত্র তীর্থস্থান এবং হজের জন্য বিখ্যাত সেটিও সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বের আরেকটি কারণ। ইরানিরা ক্রমাগত অভিযোগ করে চলেছে যে সৌদিরা শিয়া তীর্থযাত্রীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে বা তাদের সঙ্গে বৈষম্য করে। শিয়া তীর্থযাত্রীরা হজের অংশ হিসেবে শিয়া রীতিনীতিতে অংশ নিচ্ছে এবং শিয়া সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটাও বিবাদের একটা বড় কারণ।
সৌদি আরবের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই প্রতিবেশী দেশগুলোকে সমস্যায় পড়তে হয়। সৌদি প্রতিহিংসার রাজনীতির আরেক শিকার প্রতিবেশী কাতার। সৌদি কূটনীতির কাছে পরাস্ত হয়েছে কাতার। কাতার বর্তমানে সৌদি আরব তার মিত্রদের অবরোধের আওতায় পড়েছে। যদিও কাতাদের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের অবরোধের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০১৪ সালেও ছিন্ন হওয়া খড়গ নেমেছিল কাতারের ওপর। সৌদি আরব, বাহরাইন আর সংযুক্ত আরব আমিরাত ওই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ‘সাময়িক’ ছিন্ন করেছিল।
তিন বছরের মাথায় আবারও সৌদি আরবের নেতৃত্বে সাত দেশ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। তালিকায় আছে মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপও। সাতটি দেশই মুসলিম প্রধান। প্রতিটি দেশের সঙ্গেই বিভিন্ন জোটে ছিল কাতারের। তারপরও এই সাতটি দেশের অভিযোগ, কাতার সন্ত্রাসবাদকে মদদ দিচ্ছে।
কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক দিয়ে কাতার কখনোই সৌদি আরবের দেখানো পথে হাঁটেনি। বরং প্রত্যাখ্যান করে নিজের শক্ত অবস্থানই নিয়েছে। ২০১১ সালে মিসরে হোসনি মোবারকের পতনের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান ঘটে। কাতার একে স্বাগত জানায়। বিষয়টি সৌদি আরবকে ভাবিয়ে তোলে। সৌদি আরব চায় মধ্যপ্রাচ্য ‘স্থিতিশীল’ থাকুক। এটা ওই এলাকার জন্য প্রয়োজন বলে মনে করে সৌদি। দেশটির অন্যান্য মিত্রদেশগুলোও মনে করে, যদি ওই এলাকায় বিপ্লবাত্মক কিছু হয় তাহলে তা ‘হুমকি’ হয়েই আসবে।
এই যখন অবস্থা, তখন কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। ২০১৩ সালে ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসির পতন হয়। ক্ষমতায় আসেন আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। সৌদি সরকার সিসি সরকারকে স্বাগত জানায়। কিন্তু কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরা অবস্থান নেয় সিসি সরকারের বিরুদ্ধে।
কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটা বার্তা দিয়েছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যে মূলত নেতৃত্ব দেয় সৌদি আরব। আর দেশটির চোখে ইরান ‘গণশত্রু’। যদি ইরানের সঙ্গে হাত মেলায় কেউ, তা সে যে-ই হোক, ক্ষমা নেই। (চলবে)
সহযোগিতায়: ইসরাত বিনতে ওয়াহিদ, গবেষক, লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স-এর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ থেকে এমএসসি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)