আতঙ্ক যারা ছড়ায়, তারা জানে এর একটা প্রচ্ছায়া পড়ে সমাজের উপর। সমাজ এই আতঙ্কের মূল্য দেয় কানা-কড়ি দিয়ে, আরোও দেয় মনোজাগতিকভাবে দুর্বল হয়ে। এ রকম আতঙ্কের মুখোমুখি একবার হয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরো একবার এর দেখা মিলল নিউইয়র্কে এসে। মনে রাখা দরকার সমাজে আতঙ্ক ছড়ালেই সমাজকে এর খেসারত দিতে হয়, আর খেসারতের ফায়দা কেউ কেউ ঘরে তুলে নেন অত্যন্ত সুচতুর ভাবে। তাই যারা আতঙ্ক ছড়ায়, তাদের যেমন চিনে নিতে হয়, যারা আতঙ্কের ফায়দা ঘরে তুলে নেন, তাদেরকেও চিনে নিতে হয় সমানভাবে।
আজকাল নিউইয়র্ক নগরীতে আসা হয় সপ্তাহে বেশিরভাগ দিনেই। ইহুদী ধর্মালম্বীদের উপাসনালয় ‘সেনাগগ’ কিংবা তাদের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বাইরেই দেখা যায় পুলিশের গাড়ির উপস্থিতি। এই বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য নিউইয়র্ক সিটি গভর্নমেন্টকে গুনতে হচ্ছে বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলার! যে কারণে নাগরিকদের উপর ট্যাক্স বেড়েছে, বেড়েছে রাস্তাঘাটের টোল। খ্রিষ্ট ধর্মের কোনো চার্চ কিংবা হিন্দু-শিখ মন্দির কিংবা মুসলমানদের কোনোও মসজিদের সামনে এই পুলিশ নেই। তাহলে সেনাগগের সামনে কেন? এই ঘটনার সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগে।
হঠাৎ একদিন প্রায় সব টিভি চ্যানেলে ও পত্র-পত্রিকায় দু’টি কালো মতন উদ্ভ্রান্ত লোকের ছবি প্রকাশ পেল, তারা নাকি বোমা মেরে নিউইয়র্কের ব্রোঙ্কস-এর একটি সেনাগগ উড়িয়ে দিতে চায়! এরা কারা? এঁদের একজন নও মুসলিম এবং আরেকজন সদ্য জেল ফেরত। এরা যে মসজিদে যেতো বলে বলা হচ্ছিল, সেটা আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরের পথ নয়। ওই মসজিদে যাওয়া অনেকেই আমার বন্ধু স্থানীয়। তারা বলেছেন, কখনো তারা ওই লোকগুলোকে মসজিদে দেখেননি। হ্যাঁ, আল এখলাস মসজিদের ইমাম বলেছেন- ঘটনার কয়েকদিন আগে দু’টো লোকের একটি এসে মসজিদে বলেছে সে মুসলমান হতে চায়, এবং তাকে যথারীতি কলেমা পড়িয়ে মুসলমান বানানো হয়েছে! কিন্তু মুসলমান বনেই যে সে বোমা হাতে নিতে যাবে, সেটা কে জানতো?
বর্তমান বিশ্বে অনেক ঘটনা ঘটছে, যার সামান্য কিছু আমরা জানি মিডিয়ার বদৌলতে। যা জানি, তারও আশিভাগ মিথ্যা! এই যেমন- দীপন মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ বলে দিল- যে সব ব্লগারকে ইতোমধ্যে হত্যা করা হয়েছে, তারা নাকি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লিখতেন! ঘটনার প্রকাশেই আড়াল হয়ে যায় হত্যাকারীরা। সমাজের নিরান্নব্বই ভাগ মানুষ মনে করল- ‘ও বুঝেছি, যাদের হত্যা করা হচ্ছে এরা সবাই নাস্তিক!’ ক্ষীণ কণ্ঠে তুষার যদিও বলেন- দীপন নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন; কিন্তু তার আগেই সবাই জেনে গেল দীপন এবং অপরাপর ব্লগার সবাই নাস্তিক! আর নাস্তিক হত্যা করলে গুনাহ নাই, তবে পূণ্য হলেও হতে পারে! যারা এই হত্যার ঘটনা শুনে, তারাও মনে মনে খুশি হয়। পুলিশ তো হয়ই। কারণ পুলিশও তো সমাজেরই মানুষ!
হানিফের কথা শুনে অনেকেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন! আরে, হানিফদেরকে ক্ষমতায় তো আমরাই বসিয়েছি। হানিফের দলের একটি তালিকা তৈরি করুনতো, ওই দলে সুস্থ মাথার কে কে আছেন? রাজনীতিকদের সীমাবদ্ধতা জেনেই আমরা তাদের হাতে আমাদের নিরাপত্তার বোঝা চাপিয়েছি। এখন শুধু তাদের ঘাড়ে দোষ চাপালে চলবে না। তার আগে আসুন, আমরা কি করতে পারি, এর একটি তালিকা তৈরি করি।
যে রাজনীতিকরা এখনো জেলের বাইরে আছেন, ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাবিহীন, তাদের নিয়ে ঐক্য-সমঝোতার কথা বলি টেবিলে বসে। বোঝাই- ঐক্য ছাড়া পশু শক্তি জামাত-শিবিরকে মোকাবেলা করা যাবে না! জামাত আত্মপ্রকাশ করবেই, নামে-বেনামে! যারা চাপাতি চালায়, মানুষ খুন করে তাদের কোনো দল নেই, ধর্ম নেই! দীপনের বাবা আমার প্রিয় একজন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। আশির দশকে তাঁর লেখা বই দিয়েই শুরু। উদ্যোগটা নিতে হবে বুদ্ধিজীবীদেরকেই। ছাত্ররা বিভক্ত, নাম লিখিয়েছে পরাজিতের কাতারে। যুদ্ধাপরাধীদেরকে যদি আমরা রাজনীতির অঙ্গন থেকে পৃথক করতে না পারি, ঐক্য ও সমঝোতার পক্ষে সমাজকে জাগ্রত করতে না পারি, তাহলে আরো মৃত্যু, আরো বিভীষিকা আমাদেরকে তাড়া করবে!
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের অন্ধকারে শিবির আক্রমণ চালাতো বিভিন্ন হলের কক্ষে কক্ষে। প্রায় তিরিশ বছর আগে, ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন ক্ষমতাসীন সংগঠনের ক্যাডার হামিদের হাত কাটা দিয়ে শিবিরের ইসলামী বিপ্লবের যাত্রা শুরু। যারা আক্রমণের শিকার হত, তারাই শামিল হত পরের দিন মিছিলে। কেউ-কেউ গা ঢাকা দিত। কিন্তু কয়েক বছরের ঐক্য প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগ, ছাত্রদল নিজেদের ভদাভেদ ভুলে ঐক্য গড়ে তুলে এই পশু শক্তির বিরুদ্ধে। শিবির হয় পরাজিত প্রথমতঃ নৈতিকভাবে।
আজ অনেকেই জানেন- জামাত-শিবিরের ভিত্তি যে কেবল বিএনপি-তে, তা নয়। জামাতের অনেক সমর্থক আছে আওয়ামী লীগেও। আর এভাবেই আস্তিক-নাস্তিক ধুয়ো তুলে শিবির এক আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করেছে। কোনো বিচারকের আদালত নয়, বরং শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ঐক্যই মোকাবেলা করতে পারে এই পশু শক্তিকে। দীপনের বাবা- আবুল কাশেম ফজলুল হক সে কথাই বলেছেন। দুঃখের তিমিরে দাঁড়িয়েও তিনি জাতির জন্য মঙ্গলময় আলোর দিশা দিয়েছেন। আসুন আমরা তাঁর এই আহবানে সাড়া দেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই- নারায়ণগঞ্জের তকী, সাংবাদিক সাগর-রুনী, সিলেটের শিশু রাজনসহ এবং তরুণ ব্লগার ও লেখক খুন-হত্যা ঘটনা সবই আমাদের সমাজে দাপুটে অপশক্তির প্রকাশ। এদের বিরুদ্ধে শুভ শক্তির যুদ্ধ ঘোষণার সময় এখনই। এই যুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের সময় এখনো আসেনি। শুধু প্রয়োজন- দলহীন মানুষের এক বিশাল গণজাগরণ! এর নেতৃত্বে থাকবেন- আপনি-আমি সকলেই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)