ছেলেবেলার শারদীয় দুর্গোৎসবের সাথে বড়বেলার দুর্গোৎসবকে ঠিক মেলাতে পারিনা। ছেলেবেলায় যে উৎসব ছিলো আমাদের প্রাণের উৎসব, ছিলো সার্বজনীনতায় মোড়ানো, আজ তা হয়ে পড়েছে নিতান্তই কর্পোরেট, পুঁজি আর টাকার ঝনঝনানি। প্রাচুর্য্য বেড়েছে কিন্তু প্রাণ হারিয়েছে। আর প্রাণহীন উৎসব ঠিক কতোটা উৎসব থাকে? এটা নিতান্তই বয়সের তারতম্য কিংবা সময়ের স্রোত নয়, বরং উৎসবের ধরনে আসা ব্যাপক পরিবর্তনের ফল। মানুষ প্রতিনিয়ত জীবিকার পিছনে ছুটে চলতে চলতে ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’তে পরিণত হয়েছে।
সার্বজনীন উৎসব বন্দী হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির স্পন্সরের খাঁচায়। আর সবচেয়ে বড় যেটা পরিবর্তন হয়েছে, তা হলো চারদিকে যে ‘মানুষ’ দেখতাম, তারা ক্রমান্বয়ে কেবল ‘হিন্দু’ আর ‘মুসলমান’ হয়ে গিয়েছে। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা পুজো দেখতে যেতাম যেমন দল বেঁধে, পুজোর আয়োজনও হতো দল বেঁধেই। বারোয়ারি পুজো বা সার্বজনীন পুজোর ধারণাই তো এসেছিলো সেভাবে। আগের মতো এখনো হয়তো দশজনের টাকা চাঁদা তুলে পুজো হয়, ঈদগাহ সাজানো হয়, তারপরও আজকের দুনিয়ায় প্রাচুর্য্যই সব। লোক দেখানো প্রাচুর্যে্যর প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমাদের প্রাণের উৎসবগুলো থেকেও প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে।
আগে পুজোমণ্ডপে বাজতো রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-পঞ্চকবির গান, এখন সে স্থান দখলে নিয়েছে ‘লুঙ্গিড্যান্স’ কিংবা ‘নাগিন’। এসব প্রতিযোগিতা আসলে প্রাণের নয়, প্রাচুর্য্যের। কে কিংবা কোন মণ্ডপ কমিটি কার চেয়ে কতো বেশি প্রাচুর্য প্রদর্শন করতে পারে! কোনো কোনো মণ্ডপ তো রীতিমতো ভিআইপি আর উচ্চবিত্তদের মন্দিরে পরিণত হয়েছে। গুলশান-বনানীর পূজামণ্ডপ তো সার্বজনীনতার ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে। রাজধানীতেই কেবল নয়, এমন এখন দেখা যাচ্ছে মফস্বল জেলা-উপজেলা শহরগুলোতেও।
বাংলাদেশের মানুষ চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহে এখানে কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক অ-সম্প্রীতির জন্ম হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর এই ভূমির সিংহভাগ মানুষ এখনো পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। তবে সঙ্কটটা কোথায়? সঙ্কট হলো স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ নামের অমানুষ। তাদের অপকর্মের কাছে সিংহভাগ মানুষ যেন অসহায়। আসলে খারাপ লোকের কারণে সমাজ নষ্ট হয় না। খারাপের বিরুদ্ধে ভালো মানুষের নিষ্ক্রিয়তায় সমাজ বখে যায়। আমাদের সঙ্কটটা সেখানেই।
ভারতের রাম মন্দির-বাবরী মসজিদ বিতর্কে এখানে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তখনও আমাদের এলাকায় দেখেছি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরাই হিন্দুদের মন্দির রক্ষা করতে অমানুষদের বিরুদ্ধে লাঠি ধরে দাঁড়িয়েছেন। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে মন্দির পাহারা দিতে দাঁড়িয়েছেন। সেই সম্প্রীতি আজো আছে। তবে ভালো মানুষেরা ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন, নিজের নিজের জীবন-জীবিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হচ্ছেন, অপকর্মের বিচার হয় না দেখতে দেখতে ভীত হচ্ছেন, ফলে তাদের নিষ্ক্রিয়তার বিপরীতে অমানুষদের অপকর্মগুলোই সক্রিয় হচ্ছে। ফলে অপকর্মগুলোই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আর সম্প্রীতির গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বিদ্বেষ বাড়ছে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে।
আমাদের ছেলেবেলায় এসব বিভেদ দেখিনি। আজ বড় হতে হতে মাঝবয়সে পৌঁছাচ্ছি যখন, তখন কেবলই এসব বিভেদের আগুন জ্বলতে দেখছি। আমার ছেলেবেলা কেটেছে মুসলমানদের কোলেপিঠে। খেয়েছি মুসলমানের সাথে এক থালায়। মা রেঁধেছেন, এখলাস কাকা ভাত বেড়ে দিয়েছেন। বাবা হাত খরচের টাকা দিয়েছেন, ইসহাক কাকার কাছে খেলনা কেনার বায়না করেছি। রক্তের মামা-মাসি-কাকা-পিসীর সাথে ইউসুফ কাকা কিংবা পবিত্র পিসীর কীসে তফাত- কোনোদিন বুঝিনি। আমার ভালো বন্ধু রাজীব দত্ত নাকি মুর্শিকুল ইসলাম- কোনোদিন জানিনি। মাসুদ রানা মামা বলে ডাকতো, ওর মায়ের সাথে আমার দিদির কতোটুকু পার্থক্য- কোনোদিন ভাবিওনি। কলেজ জীবনে আলাউদ্দিন নাকি প্রদ্যুৎ ঘোষ কে বেশি আপন ছিলো- কোনোদিন মনেও করিনি। প্রভাত স্যার কিংবা হায়দার স্যার আলাদা কোনো সত্তা কিনা মনেও আসেনি কোনোদিন। রমেশ স্যারের সাথে মহসীন স্যারের পার্থক্য বলতে শুধু বুঝতাম একজন ইংরেজির শিক্ষক, আরেকজন রসায়নের।
আমাদের সে ঐতিহ্য আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষে নীল হয়ে যাচ্ছে।
ক্রিকেট দলে সৌম্য সরকার কিংবা লিটন দাসের উপস্থিতি মেনে নিতে আমাদের আজ কষ্ট হয় পারফরমেন্সের চেয়ে হিন্দু বিবেচনায়। মেয়র আতিকুল ইসলাম পুজো মণ্ডপে ঢাক বাজালেও নানা কথা শুনতে হয়। কিংবা কোনো হিন্দু এমপি ঈদগাহ মাঠে গেলে কটু কথা শুনতে হয়। “ধর্ম আমার, উৎসবও আমার” এই বর্বর কথা শুনতে হয় আজ। অথচ এমন আগে ছিলো না। আমাদের মগজে এখন ছোটবেলা থেকেই গেঁথে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। এ থেকে দ্রুত মুক্তি না মিললে অদূর ভবিষ্যতে চারদিকে কেবল ‘হিন্দু’ আর ‘মুসলমান’ই পাওয়া যাবে, ‘মানুষ’ আর মিলবে না।
সাম্প্রতিককালে এসব বিদ্বেষ-বিভেদের আগুন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে বন্ধু-কবি বীথি রহমানকে বলেছিলাম, একটা কবিতা লেখেন, মানুষ নিয়ে, মানুষের কবিতা। বীথি লিখেছেন। ওঁর কবিতা দিয়েই শেষ করছি:
“মা যে মানবশিশুর জন্ম দিয়েছিলেন তার কোনো ধর্ম গোত্র ছিল না
দিন পেরুতেই নামের আড়কে ধর্মের মোড়ক পরানো হল
মানবশিশু থেকে হয়ে গেলাম মুসলমানের বাচ্চা।
ছেলেবেলায় খেলার ছলে কে যেন মন্ত্রণা দিয়েছিল,
শান্ত কালো পিঁপড়া আমার গোত্রের।
বিদ্বেষ আগুনে সেদিন পিষে মেরেছি বিধর্মী লাল পিঁপড়াদের
প্রবল আক্রোশে চটকে মেরেছি পুরো কলোনী।
পাঠশালার বন্ধু তাপসীর সাথে খুব ভাব ছিল
এক ছুটির বিকেলে পা রাখলাম তাপসীদের ঘরের দাওয়ায়
উঠোনে লাকড়ির ব্যঞ্জনে ব্যস্ত ছিলেন মাসীমা
আটপৌড়ে শাড়িতে নিরীহ সেই মানুষটা হঠাৎই
ক্ষেপে গেলেন অচ্ছুৎ আমার গৃহপ্রবেশে-
হিন্দুর ঘরে মোছলেম! ছেঃ ছেঃ কত বড়ো পাপ!
নির্ঘাৎ নরকবাস!
তড়িঘড়ি গঙ্গাজলে মুছে দিলেন পাপের পদচিহ্ন।
লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম সেদিন
সারা বিকেল কেঁদে সাঁঝের বেলা মাকে শুধালাম
মা গো, মুসলমান হওয়া কি অপরাধ?
কেন ও পাড়ার মাসীমা ঘরে ঢুকতে দেয় না?
বুকের ওমে জড়িয়ে আমার স্বল্পশিক্ষিত মা বললেন,
ও ঘরে যেও না, গেলে পাপ হয়।
পাপের ভয়ে আর ওমুখো হইনি।
তাপসীও আসেনি কখনো
পাঠশালায় মুখোমুখি হয়ে গেলে জড়োসড়ো হয়ে
দুজন সরে যেতাম দুদিকে
ধর্ম কি তা বোঝার আগেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম জাতপাত
গোত্রের দোহাই দিয়ে বন্ধুত্বের কুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল
পুতুল খেলার বয়সেই।
এরপর দিন গেল, শৈশব পেরিয়ে বয়ঃসন্ধি
এল টগবগে যৌবন
দিন যেতে যেতে দেখলাম
আমার অনুভূতিতে আসলে কোনো ধর্ম নেই
রক্তে নেই মুসলমান কিংবা হিন্দুর রঙ
আমার শ্বাস যে বাংলায়,
সেই বাংলার শ্বাসই তাপসী বুকে টেন নেয়
যে ঘাসের বুকে আমি ঘুমিয়ে যাই নিশ্চিন্তে,
সেখানেই পরম আস্থায় ছড়িয়ে থাকে তাপসীর কুমারী দেহ
বড় হতে হতে আশ্চর্যজনকভাবে অনুভব করলাম
আমার আসলে কোনো ধর্ম নেই,
তাপসীরও নেই কোনো জাত-গোত্র
আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি
মানুষ হয়েই চলে যাবো ওপারে
আমাদের আত্মা মিশে যাবে একই ঘাসের বুকে।”
(আমার অনুভূতিতে কোনো ধর্ম নেই; বীথি রহমান)
মানুষের আগে যেন আর কখনোই কোনোভাবেই ধর্মকে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া না হয়। মানুষ দাঁড়াক সবার আগে। ঠিক আমাদের আগেকার দিনগুলোর মতোই। আমরা আবার সুন্দর দিন কাটাতে চাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)