গত শনিবার সাউথ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর এডেলেইডে ছিল প্রবাসী বাংলাদেশী নবীন এবং প্রবীণ মায়েদের জন্য এক অনন্য, অসাধারণ দিন। স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠানে এডেলেইডের সেই শীতার্ত সন্ধ্যা ছিল হারিয়ে যাওয়া মা আর বর্তমান মায়েদের জন্য স্মৃতি জাগানিয়া এক অপূর্ব আয়োজন। ছিল সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বাংলা বইয়ের প্রথম ও একমাত্র পাঠাগার পিদিম’র উদ্যোগে এডেলেইডের বাঙালি মায়েদের মধ্যে থেকে প্রবীণ দশজন মাকে সংবর্ধনার এই অনুষ্ঠান।
‘কান্না-হাসির মা আমার’ শিরোনামের এই ব্যতিক্রমী আয়োজনে প্রথম পর্ব ছিল দ্বৈত কথামালা, মাকে নিয়ে অম্ল-মধুর স্মৃতি পর্ব, স্মৃতির মা, প্রীতির মা। তিন যুগল বক্তা তুলে ধরেছেন, ছোট বেলার মা, বড় মেলার মা, আদরের মা, শাসনের মা, তুলে ধরেছেন কর্মজীবী মা, গৃহিণী মায়ের কথা, ছিল ডিজিটাল মা, এনালগ মা, বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহার করেছেন যে প্রবীণ মায়েরা বা যারা নেই এই জগতে তাদের নিয়ে জানা অজানা নানান অভিজ্ঞতা।
এইসব কথামালার মাঝেই দর্শক থেকে উঠে এসেছে অংশগ্রহণ। দীর্ঘদিন আগে মাকে হারানো বয়স্ক সন্তান যখন কান্না আকুল হয়ে মার স্মৃতিচারণ করেন তখন হল জুড়ে এক আবেগময় আবহের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কনিষ্ঠ সন্তান যখন বাংলা আর ইংরেজিতে মিশেলে মাকে নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা চমৎকার কথা বলে তখন হল জুড়ে হাসির ঢেউ খেলে যায়।
এই অংশটি উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ফারহান আজাদ, নদী, ফারহানা ও সুমন। এরপরই দেয়া দশজন প্রবীন মাকে সম্মাননা। আজকের নবীনা মা-ই আগামীর প্রবীণা মা। জীবনের এ এক আমোঘ চক্র। আবহমান কাল ধরেই এ চক্রেই এগিয়ে চলেছে জীবনের চাকা। এ যেন রীলে রেসের সেই কাঠি যা দৌঁড়ে একজন আরেক জনের হাতে তুলে দিচ্ছে।
প্রতিকী ব্যঞ্জণায় মূর্ত এই অনুষ্ঠানেই তাই বয়োজ্যেষ্ঠ দশজন মায়ের হাতে একে একে ক্রেস্ট তুলে দেন এডেলেইডের কনিষ্ঠা দশজন মা। যেসব মায়েদের সম্মাননা দেয়া হয় তারা হলেন, আখতার জাহান রহমান, ড: আনোয়ারা ইসলাম, শাহিন বানু, মারুফা গাফফার, বায়হাতুন রোজী, ফজিলা ইসলাম, শহিন আহমেদ, রওশন আরার করিম, রেজিনা পারভীন এবং লতিফুন্নেসা হোসেন।
সম্মাননা পর্বটি উপস্থাপনায় ছিলেন নাদিরা সুলতান নদী। সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল মাকে নিয়েই গানের ডালি। গান পরিবেশনায় ছিলেন, সুখেন কর্মকার, মিতা পালিত, রিপা দেব, মাহজাবীন কাজী, দীপা পাল, আবু তৌহিদ আলম তান্নু, সায়েদা সুলতানা সাথী এবং বেদেরা হক অমন। তবলা সংগত করেন, অনুপম আইচ। গানের পর্বটি উপস্থাপনায় ছিলেন ফারহানা আজাদ এবং রোশনে জাহান তানিয়া।
মায়ের গানে এবং হৃদয়গ্রাহী কথামালা ও স্মৃতি চারণে অনেকেরই চোখ ভিজেছে ক্ষণে ক্ষণে। মাকে নিয়ে মজার স্মৃতিতে যেমন প্রাণ খুলে হেসেছেন অনেকেই, স্মৃতি কাতরতায় মুছেছেন চোখের পানিও। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন পিদিম এর কর্ণধার এনায়েত উল্লাহ।
অনুষ্ঠানে আসা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং মায়েদের সম্মাননা জানানো বাঙ্গালী সংস্কৃতির হাজার বছরের বৈশিষ্ট্য। বস্তুবাদী সমাজ পরিবারকে বাদ দিয়ে শান্তি খুঁজছে। অথচ দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনই সন্তান তথা নতুন প্রজন্মের জন্য আলোর দিশারী হতে পারে। সেই পরিবারের মধ্যমণি হচ্ছেন একজন মা। তাই পরিবারের এই নিউক্লিয়াসকে অমর্যাদা করে কোনো সমাজের পক্ষে আদর্শিক সমাজ হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে প্রবাসী নতুন প্রজন্মের মধ্যে জাগরুক রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে দীপ্যমান পিদিম পাঠাগারের এটা তৃতীয় আয়োজন। বাংলাদেশ-ঘনিষ্ট ভিন্নধর্মী রুচিশীল অনুষ্ঠান উপহার দেওয়ায় পিদিমের প্রতি এডেলেইডে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির একটি নিগুঢ় আস্থা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে।
এবারের ‘কান্না-হাসির মা আমার’ তাদের সেই আস্থাকে নিশ্চিত আরো উঁচু মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। অনুষ্ঠানে আসা দর্শক শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ভিন্নধর্মী এমন একটি অনুষ্ঠান তারা গভীর হৃদয়াবেগ দিয়ে উপভোগ করেছেন এবং ভালোলাগার অন্য রকম একরেশ নিয়েই ঘরে ফিরেছেন বলে জানান। অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার ছিল রেডিও এডেলেইড।