দার্শনিক হান্না আরেন্ট ছিলেন জার্মান ইহুদি। হিটলারের জমানায় অল্পদিন কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, অন্যভাবেও আক্রান্ত হয়েছিলেন; ভাগ্যক্রমে আমেরিকা পৌঁছে বাকি জীবন সেখানে কাটান। নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তার চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো সেই অংশ, যেখানে তিনি আলোচনা করছেন স্বৈরাচারী শাসককূল নয়, তাদের প্রজাদের অর্থাৎ সেই সমাজের সাধারণ নাগরিকদের কথা। তার দু’টি বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, ভাবলে ভুল হবে যে সেই সমাজের সকলে, এমনকি শাসকগোষ্ঠীর মেজো-সেজো কর্তারাও, ঘোরতর পাপিষ্ঠ অমানুষ। তাদের আসল অবস্থান হয়তো আরও ভীতিপ্রদ—অধিকাংশই আপাতভাবে সহজ স্বাভাবিক মনস্ক, অন্যায় বিদ্বেষ অমানবিকতা সবই সহজভাবে মেনে নেয়, মনে কোনও দাগ পড়ে না। পাপ-অমঙ্গল তাদের কাছে অত্যন্ত মামুলি ব্যাপার। বেশির ভাগ লোকের মানসিকতা এই পর্যায়ে না পৌঁছলে মুষ্টিমেয় দাগি স্বৈরাচারী তাদের রাজত্ব কায়েম করতেই পারত না।
দ্বিতীয় লক্ষণটা আরও মোক্ষম, সমস্যার আরও মূলে। এমন সমাজে মানুষ সত্যাসত্য, তথ্য-কল্পনার ভেদাভেদ ভুলে যান। যা শোনেন বা যা শুনতে চান, শোনার প্রত্যাশা করেন- সেটাই মেনে নেন। বিচারবোধ দূরে থাক, বাস্তববোধ, এমনকি সৎ বিশ্বাসও লোপ পায়। লোকে বাস করে উচ্চগ্রামের বহুশ্রুত কিছু বুলি আর আবেগের নেশার ঘোরে।
আমরা আপাতত একটা একদলীয় শাসনবৃত্তে আটকা পড়ে গেছি। আমরা চিন্তা করছি দোর্দণ্ড রাষ্ট্রশক্তিকে কতটা অধিকার দেব আমাদের ব্যক্তিজীবন সমাজজীবন করায়ত্ত করতে। চিন্তার স্বাধীনতা, কথার স্বাধীনতা, এ-সবের গভীরে অবাধ আত্মপ্রকাশের যে স্বাধীনতায় নাগরিক হিসাবে, কী নিছক মানুষ হিসাবেই, বেঁচে থাকার সার্থকতা, তাতে কতটা হস্তক্ষেপ করতে দেব। হিসাবটা আপাতত চার-পাঁচ বছরের বটে, তার জের দীর্ঘমেয়াদি, এমনকি চিরস্থায়ী হবে কি না, সেটাও আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকৃত সত্য আর প্রচারিত সত্যের মধ্যে প্রভেদ ঘুচে যাচ্ছে। সবখানে একটা অস্বচ্ছতা, একটা ধোঁয়াশা। মনগড়া বাক্যের ভিত্তিতে নানা জনের নামে তথ্যের চরম বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ চলছে। নানা জনের নামে কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। অসংখ্য চক্রান্তের কাহিনী ফাঁদা হচ্ছে। ধাপে ধাপে তা নেমে আসছে স্থানীয় স্তরে উত্তেজক রটনা, নকল ছবি আর তথ্যবিকৃতির রমরমা। অসত্য আর অর্ধসত্যের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে নিছক অসত্য-অর্ধসত্যের চেয়ে ভয়ঙ্কর এক অতিসরল কুযুক্তি আর অপব্যাখ্যার অবতারণা ঘটছে—‘যদি তুমি রাতের বেলা রাস্তায় বেরোও তো তুমি নিশ্চয় চোর’ গোছের। ক্রমে সকাল-দুপুরও মাঝরাত হয়ে যায়, অভিযোগটা চুরি ছাড়িয়ে গণহত্যায় পৌঁছয়, অভিযুক্তের অভাব হয় না।
অসত্য প্রচারের অভিনব হাতিয়ার আজ সহজলভ্য। প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক মাধ্যমে বার্তা ছড়ায় সহস্রগুণ দ্রুত; তার জন্য নির্দিষ্ট কাউকে দায়বদ্ধ করা দুষ্কর; প্রায় নিখরচায় তাকে ছবি-গান-গল্পে আকর্ষক করে তোলা যায়। আর সেই বার্তার উৎস যদি সাগর পেরিয়েও হয়, স্মার্টফোনের দৌলতে তা চলে আসে আমাদের একান্ত এখতিয়ারে, আক্ষরিক অর্থে হাতের মুঠোয়। তাতে আমাদের আত্মপ্রসাদ হয়, আস্থা জন্মায় আপনাআপনি, বিচারবুদ্ধির প্রশ্ন ওঠে না। উপাসনালয়ের পরচর্চা, হেঁশেলের ফিসফাস, চায়ের দোকানে রাজা-উজির বধ—সামাজিক মাধ্যম এ-সবের বিশ্বায়িত রাজসংস্করণ। আমাদের মতো করে, আমাদের মন জুগিয়ে পরিবেশিত এই বার্তার এমনই গ্রহণযোগ্যতা যে বিশ্বাসযোগ্যতা অবান্তর হয়ে পড়ে।
তবে বিশ্বাসের ঠাট একটা রাখতে হয় বইকি। সেটা সম্ভব হয় দুটো কারণে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সার্বিকভাবে আমাদের এতটাই আস্থা হারিয়েছে যে কোনও অভিযোগ কোনও কেচ্ছাকাহিনীই অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিতে মন সরে না। স্বীকার করতেই হয়, প্রবঞ্চনা জবরদস্তি ক্ষমতার আস্ফালন বিরোধী কণ্ঠরোধ ইত্যাদি স্বৈরাচারের লক্ষণগুলি কোনও দলের একচেটিয়া নয়, ক্ষেত্র অনুসারে তারতম্য ঘটে মাত্র। যে বাক্যবর্ষণে আমরা একশা হয়ে আছি, তাতেও প্রত্যেক দলের কমবেশি অবদান, এ কলা দেখায় তো ও ভেংচি কাটে। সংবাদের বড় অংশ জুড়ে থাকে তার মুখরোচক বিবরণ, আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।
তৃপ্ত করে তা বেশ কথা; তবে রামগরুড় বনলে বলতে হয়, আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় না আছে মূল্যবোধ না আছে সারবত্তা। রাজধর্মের নীতি, দেশের হাল সেখানে অবান্তর। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে হান্না আরেন্ট বিবৃত অন্য লক্ষণটা। তার বর্ণিত সমাজে অন্যায়-অনাচার, হিংসা-বিদ্বেষ স্বাভাবিক ও অভ্যস্ত, হয়তো এত স্বাভাবিক যে ভ্রুক্ষেপেই পড়ে না। নিজেদের দিকে তাকাই। দোরগোড়ায় বন্দুকযুদ্ধ, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন আমাদের দৈনন্দিন ছন্দে বাঁধা। জেলায় জেলায় অভ্যস্ত অশান্তি থেকে থেকে দাঙ্গায় ফেটে পড়ে ইনফোটেনমেন্টের উপজীব্য হয়ে। অতএব আরও দূরের বিপর্যয় নিয়ে হেলদোলের প্রশ্নই ওঠে না। দেশের সংখ্যালঘুরা লাগাতার আক্রান্ত হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও চলছে অন্ধকার বাহিনীর দাপট, এসবের যথার্থতা সম্বন্ধে কৌতূহল বোধ করি না। ভ্রষ্টাচার, অশালীনতা প্রভৃতি অহিংস অপরাধ ধর্তব্যেই আসে না। জনপ্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ হতে পারছে, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটে তারা সহযোগী হলেও উত্তেজিত হই না, প্রশ্ন করি না।
সত্তর-আশি বছর আগে জার্মানির নাগরিকরা নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন, ভিন্নধর্মীয় এক গোষ্ঠী প্রথমে উৎপীড়িত, তার পর স্রেফ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এত বিদ্বান দার্শনিক জাতি নিশ্চয় সন্দিগ্ধ হয়েছিল নেতৃকুলের বাগাড়ম্বরে, যার প্রধান প্রচারকের মন্ত্র ছিল কথার ভারে চৌকো জিনিসকে গোল বানিয়ে দেওয়া। কিছু লোক অবশ্যই সরাসরি যুক্ত ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশবিক ক্রিয়াকর্মে। আরও বহুগুণ মানুষ যারা ছিলেন না, যারা কর্মক্ষেত্রে সমাজে স্বগৃহে সজ্জনের মতো নিরীহ জীবন যাপন করেছেন, তারাও নিশ্চয় ব্যাপারটা আঁচ করেছিলেন বা করতে পারতেন। হয়তো চাননি বলেই করেননি, ভেবেছিলেন তারা এমন অবস্থায় দিব্যি আছেন, তাদের পবিত্র পিতৃভূমি দাপটে-সম্মানে দুনিয়ার নজর কাড়ছে, তার নাগরিক হিসাবে না-হয় কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হল, প্রাণ দিতে হলো পর্যন্ত। ভুল ভাঙল যখন, বৃহত্তর মানবিক প্রতিরোধে সেই কল্পসৌধ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।
এমন দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি আজও বিশ্বের কিছু দেশে ঘটে চলেছে, আশঙ্কায় দিন গুনছে আরও বহু দেশ। শত বিচ্যুতি-অনাচার সত্ত্বেও আমাদের দেশ কিন্তু এখনও অপার সম্ভাবনাময়। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-জঙ্গিবাদ আক্রান্ত অনেক দেশের নাগরিকদের ঈর্ষার স্থল। এই দেশটাকে ঘিরে আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের ভার নিতান্তই আমাদের হাতে। এমনকি রাষ্ট্রের মালিক সেজে যারা বসে আছেন, তাদের মনোভাবের পরিবর্তনও আমাদের সচেতন ভূমিকার উপর নির্ভর করছে। অন্যায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করে নিজের মেরুদণ্ড সোজা রেখে আমরা নাগরিকরা সেই দায়িত্ব পালন করব কি-না, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই গ্রহণ করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)