এখনকার মাধ্যমিক বা এসএসসি (সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষাই এক সময় ম্যাট্রিক পরীক্ষা নামে পরিচিত ছিল। যদিও অনেকের কাছে এ পরীক্ষা ছিল ভয় আর শঙ্কার এক বিষয়। অন্যরকম সেই ম্যাট্রিক শব্দটি আসে ম্যাট্রিকুলেশন থেকে। এর অর্থ অধিকার লাভ করা।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী কলেজ বা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনের অধিকার লাভ করতো। যার শুরুটা পাকিস্তান আমলে। ওই সময়ে এসএসসি বোঝাতে ব্যবহৃত হতো এই শব্দটি। আর ব্রিটিশ আমলে এই পরীক্ষার নাম ছিল এনট্রান্স।
সেই ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিলেবাসও অন্যরকম ছিল। পরবর্তীতে এই পরীক্ষাটিই এসএসসি পরীক্ষা নামে পরিচিত হয়। সিলেবাসেও আসে অনেক পরিমার্জন ও পরিবর্তন। আর ম্যাট্রিকের ঠিক পরের ধাপটিই ছিল আইএ। বর্তমানে যা উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি (হায়ার সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট) নামে পরিচিত।
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ব্রিটিশদের উদ্যোগে। সেটাই চলছিল অনেক অনেক দিন যাবৎ। ব্রিটিশদের প্রবর্তিত রীতি অনুসারে ১০ বছরের স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পরে প্রথম মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বা এসএসসি নামে পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হতো শিক্ষার্থীদের।
২০০৯ সালে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষানীতির আওতায় ওই বছর থেকে পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণশেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পিএসসি পরীক্ষা নামে একটি নতুন পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়। পরের বছর থেকে চালু হয় ৮ বছরের নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনী বা জুনিয়র সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা।
২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতির প্রচলন হয়। এর আগে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে গৃহীত স্কোরের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস ও থার্ড ক্লাস দেওয়া হতো নম্বরের ভিত্তিতে। সাধারণত একজন পরীক্ষার্থী গড়ে ৩৬% নম্বর পেলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে গণ্য করা হতো। একজন পরীক্ষার্থী ৩৬% থেকে ৪৫%-এর কম নম্বর পেলে তৃতীয় বিভাগ, ৪৫% থেকে ৬০%-এর নিচে পর্যন্ত নম্বর পেলে দ্বিতীয় বিভাগ এবং ৬০% বা তার বেশি নম্বর পেলে প্রথম বিভাগ পেতো। ৭৫% বা তদূর্ধ্ব নম্বরপ্রাপ্ত পরীক্ষার্থীদের স্টার মার্কস পেয়েছে বলা হতো। এরপর প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেধা তালিকা তৈরি করা হতো।
২০০১ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং ২০০৩ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বর্তমানে এ পরীক্ষায় ৮০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পেলে জিপিএ-৫, ৭০ থেকে ৭৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৪, ৬০ থেকে ৬৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৩.৫, ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৩, ৪০ থেকে ৪৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-২ এবং ৩৩ থেকে ৩৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-১ অর্জন করে শিক্ষার্থীরা।
ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক সরকার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষা সমাপনের পর একটি প্রবেশিকা পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। যা এনট্রান্স নামে পরিচিত হয়। শুরুতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই পরীক্ষাটি পরিচালিত হতো। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অর্পিত হয়।
পরে তা ম্যাট্রিকুলেশন বা ম্যাট্রিক পরীক্ষা নামে পরিচিত হয়। এই সার্টিফিকেট দুটি উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হতো: প্রথমত, সরকারি চাকরি পেতে এবং দ্বিতীয়ত, কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতে।
একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯১৭ সালে একটি কমিশন গঠন করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশন ১৯১৯ সালে কিছু সুপারিশমালা প্রকাশ করে। সেই কমিশনই সুপারিশ করে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করার।
স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালে একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বিলুপ্ত করে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ডের উপরই পূর্ববঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দেয়া হয় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাসহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব। ১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাখা হয়।
১৯৬১ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পাকিস্তানের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে পুনরায় বোর্ডসমূহের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় ঢাকা বোর্ডের ওপর। পরে এর নাম আবার পরিবর্তিত হয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড নামে অভিহিত হয়।
পরবর্তী সময়ে স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন বোর্ড স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালে ঢাকার বাইরে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় তিনটি মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে আটটি বোর্ডে ভাগ করা হয় পুরো দেশকে। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডসমূহ তাদের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত।
দেশে প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থায় কেবল মুখস্থ করার মাধ্যমে ভালো ফল লাভের প্রবণতা দেখা দেয়ায় শিক্ষাবিদরা মনে করেন এতে শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধার প্রতিফলন ঘটে না। সে কারণে এসএসসি পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় ২০১০ সাল থেকে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়।