জীবন সায়াহ্নে এসে হিসাব মেলাতে গিয়ে কোথাও যেন তাল কেটে যায়। অনেক প্রাপ্তির মাঝে ব্যর্থতার রোদন থাকে। ঠিক তেমনিভাবে দেশজুড়ে চলছে সরকারের থেকে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নিকাশ। চারদিকে নির্বাচনের বাতাস। সে বাতাসে জল্পনা কল্পনার অন্তমিল খোঁজার চেষ্টারত ক্ষমতা প্রত্যাশীরা। রাজনীতি হলো রাজার নীতি এবং প্রজারা হলো বাহুল্যমাত্র। আর সে কারণে নির্বাচনের একটা অঘোষিত ফলাফলের আভাস মানুষের মনে আছে বিশেষভাবে।
গণতান্ত্রিক সরকার হলেও দেশে তেমন কোন শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। তাই জনগণ চায় আগামীতে জনজীবন হোক ঝামেলামুক্ত। নির্বাচনে রাজনৈতিক মেরুকরণ যাই হোক। উন্নয়ন সর্বক্ষেত্রে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এক শ্রেণীর মানুষ ধনবান হচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবন সমস্যায় জর্জরিত। বাতির নীচের অন্ধকারের মতো এদের নিত্যজীবন। যে আক্ষেপের সুরে সাধারণ মানুষ আগামীর বাংলাদেশকে দেখছে তাতে মনে হলো, ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ?’ কারণ দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা ও ভোগান্তি কমার পদক্ষেপ নিয়ে হতাশ তারা। জনগণ মনে করে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু রাস্তাঘাট মেরামত, নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা নিরসন, শিক্ষা পদ্ধতিতে সঠিক ব্যবস্থাপনা, অনিয়ম দুর্নীতির দমন সত্যি কি হবে?
১০ বছর ক্ষমতাসীন থাকা দল আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীর ও জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করে জাতিকে করেছে দায়মুক্ত। উন্নয়ন পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় মেগা প্রজেক্টের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। দীর্ঘমেয়াদী সরকার সার্বিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের চিত্রকে যদি খণ্ড খণ্ডভাবে দেখা হয়, তা হলে অনেককিছু হতাশাব্যঞ্জক। যে বিষয়টি সরকারের ব্যবস্থাপনাতে লক্ষ্যনীয় তা হলো, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়তেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া জনগণ তাদের ভরসা খুঁজে পায় না। সাম্প্রতিক সময়ের নড়িয়া উপজেলার নদী ভাঙন তার জলন্ত উদাহরণ। একটা এলাকার মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা কিন্তু সে মানুষদের পাশে গিয়ে কোন মন্ত্রী সংসদ দাঁড়াননি। যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কোটা বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কসহ বিগত দিনের এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছ। যা প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে সমাধানের পথে না গিয়ে দেশ উত্তপ্ত হতো। শুধু এখানেই শেষ নয় মাঝে মাঝে নেতানেত্রীদের বালকসুলভ বক্তব্য মানুষকে করে বিভ্রান্ত। তাই এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সরকারের সাংসদ ও নেতাদের কাছে আশা -প্রত্যাশা ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।
নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মাঝে ক্ষমতাসীন সাংসদের কার্যক্রম এলাকাতে বিবেচ্য বিষয়। সে হিসাবটাকে উহ্য রেখে বর্তমান নেতারা কেন্দ্রীয় সংগঠনকে খুশি করতে ব্যতিব্যস্ত থাকে। আবার দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি তৃনমূলের সংগ্রামী নেতারা যোগ্য হয়ে ও মনোনয়ন পান না। কারণ নির্বাচন মানে এখন অর্থের খেলা। সামগ্রিক উন্নয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগ আবার জয়ী হতে প্রত্যাশী। তবে মানুষের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো কি কেবল নির্বাচনী অংগীকারে সীমাবদ্ধ থাকবে?
প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটের খারাপ অবস্থা আর বেপরোয়া যানবাহন চলাচলের কারনে মানুষের মৃত্যু নিত্য ঘটনা। জলাবদ্ধতার শিকার শহর-গ্রাম। উচ্চ দ্রব্যমূল্য আর মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বৈষম্যতাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর জীবন সংকটময়। শিক্ষা ব্যবস্থাপনাতে যে গলদ তা ছাত্র-ছাত্রীদের ফলাফল থেকে অনুমেয়। মাদকের আগ্রাসন সর্বত্র। সর্বোপরি জনবান্ধব নেতাদের অভাববোধ রয়েছে এলাকাতে। এমন সমস্যাগুলো সমাধানে জন প্রতিনিধিদের মানসিকতা কতটুকু রয়েছে তা বিবেচনা করাটা মুখ্য বিষয় এখন।
কিন্তু ৯০ এরপর গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকাংশে দেখা যায় এলাকার প্রভাবশালী অর্থবানরা দলের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচন করে। রাতারাতি নেতা হয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নির্বাচনে জয়ী সাংসদের সাথে সাধারণ জনগণের তেমন সম্পর্ক গড়ে উঠে না। অতিথি পাখির মত এলাকাতে তাদের আসা যাওয়া থাকে। এমন ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হন নানাভাবে।
উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একে অপরের পরিপূরক। তাই উন্নয়নকে বেগবান করতে হলে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অবশ্যই কাম্য। গণতন্ত্র রুদ্ধ হলে দেশে অরাজকতার পরিবেশ তৈরি হবার শংকা দেখা দেয়।
এমনিতে বর্তমান সরকারের দলের অভ্যন্তরে এক বা একাধিক প্রার্থী রয়েছে। আবার বিভিন্ন দল থেকে নানাভাবে যোগ দিচ্ছে নানাজন তাদের সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এতে করে আপাতদৃষ্টিতে সারাদেশে যে আওয়ামী সর্মথকের আধিক্য দেখা যায় তা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটা বিবেচনার দায়ভার দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতানেত্রীদের।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দেশে বিদেশে নানা প্রশ্ন সংশয় তখনি সৃষ্টি হবে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি না হয়। আর সেক্ষেত্রে ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হবে’- এমন শংকাতে ভুগবে দেশ-জাতি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)