সকালের ঘুম ভেঙ্গেছে এক শুভাকাঙ্খির ফোনে। তিনি জানালেন নিজ দেশের টেলিভিশনে লাইভে আছেন অং সান সু চি। তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে চোখ রাখলাম ফেসবুকের নিউজ ফিডে। হ্যাঁ তিনি কথা বলছেন, আশ্বাস দিচ্ছেন, আশঙ্কা করছেন, রোহিঙ্গাদের ইস্যুতে বাংলাদেশকে দায়ী করতে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা বাংলায়? বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
এত এত কথার পরও মানবিক এই আমির মনটা কিছুতেই ভরাতে পারলো না, মিয়ানমারের শান্তির অবতার সুসজ্জিত সু চি! বরং তার জন্য কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্য অনুভূতি কাজ করছিল অন্তর জুড়ে।
উখিয়ার থাইংখালীতে রোহিঙ্গাদের জীবনী তাদের মুখ থেকেই শুনেছি, দেখেছি তাদের অবর্ণনীয়, অমানবিক জীবন। যে শিশু এখনো বোল সেখেনি, সে সামান্য শব্দেই কেঁদে উঠছে, কেঁপে উঠছে তা কি সু চির আত্মাকে কাঁদায়, কাঁপায় অন্তরও তার? মনে হয় না। দগ্ধ হওয়া শরীর, কাঁটায় ছিড়ে যাওয়া শরীর- খোঁচা খাওয়া পা, কাঁদায়-কান্নায় ভেসে আসা সুর কি সু চি কে একবারের জন্য ব্যথিত করে, আপ্লুত করে? করে না, তাহলে তার জন্য কি শ্রদ্ধা আসে? আসবে?
এই যে লোক দেখানো, বিশ্ব নেতাদের বিভ্রান্ত করতে দেয়া সরল ভাষণ, সেখানেও রাজনীতি করেছেন বিখ্যাত এই নারী নেত্রী। বিশ্ববাসীকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে, এইসব জাতির মানুষ সব বাঙ্গালী এবং তারা সন্ত্রাসী। তাই সন্ত্রাস দমন করছে মিয়ানমার। সত্যি বলার এবং স্বীকার করা সাহস নাই কেন মাননীয়া?
অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটকে তার সরকার যেভাবে মোকাবিলা করছে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ভয় করেন না তিনি। মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেয়া সরাসরি টেলিভিশন ভাষণে এ কথা বলেছেন তিনি। এই প্রথমবার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বললেন সু চি। ২৫ আগস্ট থেকে সংকট শুরু হওয়ার পর এ বিষয়ে কথা না বলায় আন্তর্জাতিক মহলে কঠোর নিন্দার মুখে পড়েন সু চি।
রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৪ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরবাড়ি, বসতভিটা। খুন-ধর্ষণসব নারকীয় সব তাণ্ডব চালানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে।
তারা ছুটে আসছেন বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশের সীমান্তেও নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারপরও তারা এই শেষ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশকেই নিরাপদ মনে করছেন। কারণ বাংলাদেশের মানুষ এবং বাংলাদেশ প্রধান অত্যন্ত মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। বাংলাদেশীরা শত কষ্টের মাঝেও হাসতে জানে, ভালোবাসতে জানে, ভাগাভাগি করে খেতে জানে। অনেক সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও আশ্রয় দিতে জানে। নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকি জেনেও শুত্রু-মিত্র না ভেবেই আগলে রাখতে জানে এজন্য বাংলাদেশকে নিরাপদ আশ্রয় ভাবছেন রোহিঙ্গারা।
এবার আপনি খুঁজে বের করুন অপ্রিয় সু চি আর কী কী কারণ থাকতে পারে। কাউকে বা কোন দেশকে দোষারোপ করতে চাইলে এমন অনেক ইস্যু পাওয়া যাবেই। যা দিয়ে সে দেশকে বিব্রত করা যায়- কিন্তু ভালোবাসতে একটা কারণই যথেষ্ট। আপনি মহান, মানুষকে ধর্ম দিয়ে বিবেচনা করেন। ধর্মীয় মতাদর্শকে শিরোধার্য মেনে চলাই হয়তো আপনার নীতি বা রীতি। কিন্তু জেনে রাখবেন আমরা বাঙ্গালীরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৈশাখ পালন করি, পুজা-পার্বন, ঈদ উৎসব, বড়দিন পালন করি। আমরা একসাথে চলি, একই ভাষা বলি।
আমরা সবাই জানি, দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমার ও দক্ষিণ উপকূলের দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম আয়তন হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম, ফলে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও কম এই ক্ষুদ্রায়তনের দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ১৫.৫৯ কোটির বেশি অর্থাৎ প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৪৯৭ জন।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের উর্বর অববাহিকায় অবস্থিত এই দেশটিতে প্রায় প্রতি বছর মৌসুমী বন্যা হয়, আর ঘূর্ণিঝড়ও খুব সাধারণ ঘটনা। নিম্ন আয়ের এই দেশটির প্রধান সমস্যা পরিব্যাপ্ত দারিদ্র গত দুই দশকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুত, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সফলতা। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, রোহিঙ্গা সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সুস্পষ্টভাবে জাতিসংঘ সনদের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং বিশ্বসম্প্রদায়ভুক্ত একটি জাতি হিসেবে সকল দায়দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করার কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিসমূহ সন্নিবেশিত হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন’ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এরই অনুসৃতিতে সংবিধানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অভিমুখ নির্ধারণ করে ৪টি মূল স্তম্ভ রয়েছে:
১) জাতীয় সমতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা;
২) শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ প্রয়াস;
৩) নিজস্ব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনে প্রত্যেক জাতির অধিকারের স্বীকৃতি এবং
৪) বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে সমর্থন।
মিয়ানমারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা কোন দেশ নয়, কেবল একটি জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বজুড়ে। এর বাইরে তাদের আর কিছু নেই। আপনার কানে এ কথাগুলো যাবে না হয়তো।
তাই আপনাকে আর কিছুই বলার নেই মাননীয় নোবেল লরিয়েট, কিন্তু আমরা তো আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই পারি। আপনার প্রতি একরাশ ঘৃণা। আর আমাদের প্রতি, বাংলাদেশীদের প্রতি আহ্বান, আসুন, আমরাই সু চি কে ‘না’ বলি। আমাদের সকল কর্মে, সকল কথায়, ব্যবসা-বানিজ্যে সু চি’কে বর্জন করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)