
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ
মার্চ মাসের শুরুতেই সারা বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সবকিছু চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে মূলত বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে। মার্চ মাসের শুরু থেকেই পুরো বাংলার নিয়ন্ত্রণ কার্যত চলে আসে বঙ্গবন্ধুর কাছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয়েছে। ২ মার্চ ছাত্ররা সেই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে, তুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ভাষণ দেবেন। শেখ হাসিনা সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। মা সবাইকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, মা আর আমি। মা বললেন, তুমি ১০টা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও’।
শেখ হাসিনার ভাষায়-‘আমি মাথার কাছে বসা, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলোর জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা’।
সে রকমটাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, কোন লিখিত বক্তব্য বা চিরকুট হাতে না নিয়েই ৭ মার্চের বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। মনের ভেতরে লালিত বাসনা, স্বপ্ন ও প্রোথিত সংলাপের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন ৭ মার্চের ভাষণে। আর ভাষণটিতে ফুটে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
বঙ্গবন্ধু তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে স্বাধীনতার সূর্যকে উজ্জ্বলতর করেছিলেন। কী অসাধারণ দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম ছিল বঙ্গবন্ধুর, ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সভামঞ্চে হাজির হয়েছিলেন। সে দিনের রেসকোর্স ময়দানে মানুষজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে। রেসকোর্স ময়দানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না, লোকে লোকারণ্য ছিল চতুর্দিক। এটি এমন এক আবেগতাড়িত, তেজোদীপ্ত, মর্মস্পর্শী এবং উদ্বেলিত ভাষণ যেটি বিগত আড়াই হাজার বছরের মধ্যে যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে উদ্দীপনা, উৎসাহ প্রদানে এবং বিজয়ার্জনে সর্বোৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছে বাস্তবায়ন সাপেক্ষে।
ভাষণটির প্রত্যেকটি শব্দ মোক্ষম মাধ্যম, শপথের স্লোগান হিসেবে কাজ করেছিল বলেই বাঙালি জাতি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিল। জ্যাকব এফ ফিল্ডের “we shall fight on the beaches: The speeches that inspired history” ” গ্রন্থে গবেষণার মাধ্যমে বিষয়টির যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। এখনো এ ভাষণের মর্মার্থ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সেমিনার, কনফারেন্স, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ভাষণের পেছনে বেগম মুজিবের কতটুকু অবদান ও তাৎপর্য রয়েছে তা নতুন করে ভাবনার বিষয়কে উন্মোচিত করে। স্বাধীনতা, স্বাধীকার, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির পেছনে ফজিলাতুন নেছার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও অনুপ্রেরণা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে বেগবান করেছিল। মানসিক শক্তি, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম এবং মানবিকতাবোধের অপূর্ব মিশেল ছিল ৭ মার্চের জগদ্বিখ্যাত ভাষণটিতে। নতুন প্রজন্মের গবেষকরা এই ভাষণটির অর্ন্তর্নিহিত তাৎপর্য খুঁজতে বিশদভাবে কাজ করতে পারেন।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ
৭ মার্চের ভাষণের পরে কার্যত বাঙালি এবং বাংলাদেশের কর্তৃত্ব চলে আসে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তাকেই ঘিরে আবর্তিত হত বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং সে সব ইস্যুতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ২৩ মার্চ পল্টনের ময়দানে জনসভার আয়োজন করে। সে জনসভায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়া হয় এবং সে রাতেই রেডিও টেলিভিশনে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশিত হয় সঙ্গীতটি। আর এসব কাজে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সমভাবে সহযোগিতা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করেছে, স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত করেছে, সময়ের দাবিকে পূরণ করেছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এর প্রতিটি ইউনিটের নেতাকর্মীর সাথে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সুসম্পর্ক ছিল। আর ছাত্রলীগের কোন কর্মসূচি উদযাপন বা বাস্তবায়নের পূর্বে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন নেতাকর্মীরা।
১৯৭১ সালের ২২ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পাকিস্তান দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের আলোচনা নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে উৎকণ্ঠিত ছিল। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখনির মাধ্যমে জানা যায়, ২৩ তারিখ পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে আপনি কি কোন সিদ্ধান্ত নিলেন?’ প্রতি উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না নিতে পারিনি। আমি পতাকা ওড়াতে চাই। একটাই ভয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখনো ঢাকায়। পাকিস্তানিরা বলবে, আলোচনা চলা অবস্থাতেই শেখ মুজিব নতুন পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই অজুহাত তুলেই তারা নিরস্ত্র বাঙালির উপর সামরিক হামলা চালাবে।’ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল বিষয়টা, ৭ মার্চের মতো দোদুল্যমান অবস্থায় থেকে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সরাসরি হস্তক্ষেপে স্বার্থক পরিণতি পাবে। ৭ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণার কথা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিল, পরিপ্রেক্ষিতে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কথা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমন ঘোষণার পরে বাঙালিরা বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধ ব্যতীত মুক্তি সম্ভব নয়, তাই তারা যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
এমন কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধু প্রিয়পত্নী রেণুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রেণু তুমিই বলো, আমি কী করবো? ৭ মার্চ তুমিই তো আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলে।’ বেগম মুজিব বললেন, ‘আপনি ছাত্রনেতাদের বলুন, আপনার হাতে পতাকা তুলে দিতে। আপনি সেই পতাকা বত্রিশ নম্বরে ওড়ান। কথা উঠলে আপনি বলতে পারবেন, আপনি ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।’ এর পরেই বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন আগামীকাল ৩২ নম্বরে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হবে। সাথে সাথে সেই মাঝরাত্রীতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সরগরম হয়ে উঠেছিল আনন্দ মিছিলে। এই ছিলেন আমাদের ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে যিনি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনের পরেই বাংলার ছাত্রসমাজ নিজেদের মধ্যে একাত্ম হয়ে সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেন দেশব্যাপী। ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে।
চলবে…