সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণকে তথ্যপূর্ণ নয় বলছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বাতিল না করলেও সংশোধন ও আধুনিকায়ন প্রয়োজন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনও নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনও ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনও নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
গত ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণে ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আদালত বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। এতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদের স্থায়িত্ব ও দলের সদস্যদের মধ্যে শৃংখলা ধরে রাখার জন্য একটা ব্যবস্থা মাত্র। এটা দেশের জাতীয় রাজনীতিকে রাজনৈতিক বেচাকেনা থেকে দূরে রাখার জন্য। রায়ে বলা হয়, একজন সংসদ সদস্য যদি দরকষাকষির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বা সন্দেহ হয় যে তিনি দরকষাকষির সঙ্গে যুক্ত, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান সংবিধানে নেই। এ অবস্থায় তারা (সংসদ সদস্য) উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কিভাবে নিতে চান?
রায়ে বলা হয়, ৭০ অনুচ্ছেদ থাকার কারণে দলীয় নির্দেশনার বাইরে একজন সংসদ সদস্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সেখানে বিচারক অপসারণের বিষয়ে তারা কিভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে মত দেবেন।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষনে আরও বলা হয়, বর্তমান ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সংসদ সদস্যদের একটি দলের (গ্রুপ) হাতে। এ ব্যবস্থায় দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার স্বাধীনতা নেই কোনো সংসদ সদস্যের। এমনকি তার দল যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা নিদের্শনা দেয় তাহলেও তার বিরুদ্ধে ভোট বা মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। তারা দলের নীতিনির্ধারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। ৭০ অনুচ্ছেদ বলবৎ থাকাবস্থায় বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে একজন বিচারককে দলীয় নীতিনির্ধারকের করুণা অনুযায়ী চলতে হবে। এ অভিমত দিতে আমরা কোনো ভুল দেখি না।
রায়ের দশ দিনের মাথায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়। আর তড়িঘড়ি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা দুঃখজনক অভিহিত করে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণে এই কাউন্সিল অস্বচ্ছ এবং নাজুক।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকায় সাংসদেরা বিচারপতি অপসারণে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিনা এই প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে যেটা আছে সেটা হচ্ছে, যদি কোনো সংসদ সদস্য যে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন তাহলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ চলে যায়। সংসদীয় চর্চায় দল যখন বলে দেয় যে এই ইস্যুটা দলের, এর বাইরে ভোট দেওয়া যাবে না, তখনই কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ আসে। তবে সময় সময় তাঁদের ফ্রি ভোট দেওয়ারও সুযোগ আছে।
‘‘তাহলে ওনারা যে রায়ে বলেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদের জন্য ষোড়শ সংশোধনী বিতর্কিত হবে, সেটা কিন্তু ঠিক না। তার কারণ হচ্ছে, ওনারা এটা সম্পর্কে জানেন না যে বিচারপতিদের বিষয়ে পার্টি ভোট হবে না ফ্রি ভোট হবে।’’
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, যে পদ্ধতি দিয়ে তাঁরা (সরকার) আইনের খসড়া করেছিলেন, সেখানে কিন্তু ‘পার্টি লাইনে’ ভোট হবে এমন কথা ছিল না এবং এমন কোনো ইঙ্গিতও ছিল না। সে ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু তথ্যনির্ভর নয়।
সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বক্তব্যের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আইন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা যদি আদর্শগত ভাবে চিন্তা করি তাহলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কারণ একজন সংসদ সদস্যের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষমতা এখানে থাকছে না, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার উপায় থাকছে না।সুতরাং সে হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের রায় ঠিক আছে।
‘‘আবার যদি বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা করি তবে ৭০ অনুচ্ছেদের দরকারও আছে। কারণ এ ধারা না থাকলে আমাদের এমপিরা যেকোন সময় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে। তাতে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, আজ এ সরকার কাল অন্য সরকার এসে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।’’
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন: আইনমন্ত্রী বা সরকারের অবস্থানের সঙ্গে আমি একমত নই। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই হয়তো ৭২ এ ধারাটি সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও কেন অন্য দেশের নেতিবাচক দৃষ্টান্ত সামনে রেখে তা বলবত রাখতে চাইছেন। পুরোপুরি বাতিল না করলেও সময়ের সঙ্গে এটির সংশোধন বা আধুনিকায়ন দরকার ছিল।