Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

স্মৃতিতে ভাস্মর: জাতীয় চার নেতা

বাংলাদেশের চারপ্রান্ত থেকে এসেছিলেন চারটি নক্ষত্র, ধ্রুবতারার মতোই জ্বলজ্বল করে উঠেছিলেন আপন মহিমায়। চারটি নদীর মোহনা যেখানে একত্রিত হয় সেখানকার স্রোতের তেজস্বিতায় ঝড়ঝাপটা কিংবা কোন রকমের বাঁধই স্রোতকে বেঁধে বা গতি কমাতে পারে না। সামনের অজেয় গতিকে আরো তীব্রময় করে পরিবেশটাকে করে তোলে মনোরম তথা জনসাধারণের নিকট সে দৃশ্যই হয়ে উঠে অবলোকনকর।

নদীর স্রোত সামনে এগিয়ে যাবে আপন গতিতে সেখানে কারো বাঁধা বেমানান, তাই তো নদীর স্রোতকে কেউ বাঁধা দিতে পারে না। সাময়িক সময়ের জন্যে আটকে রাখতে পারলেও একটা সময় পরে ঠিকি আপন মনে বহমান থাকে নদী। সকল বিপত্তিকে পদদলিত করে সাগরের নিকট পৌঁছায় নদী এবং ইহাই তার বৈশিষ্ট্য। আর চারটি নদীর মিলনস্থল যদি স্রোতস্বিনী মোহনায় হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। নদী তার সাফল্যে পৌঁছাবে শিক্ষাগুরুর দেখানো পথে। বলছিলাম বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতার কথা, যারা সকলেই তাদের জীবনকর্মে সফল হয়েছিলেন এবং বাংলা, বাঙ্গালি এবং বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে ততদিন তাদের কর্ম নিয়ে আলোচনা হবে, কেননা তাদের জীবন আলোকচ্ছটায় বর্ণিল। তারা এক মোহনায় মিলিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুঅবধি একই নীতিতে অটুট ছিলেন এবং জীবন ও দিয়েছেন একসাথে।

আজ ৩ নভেম্বর, গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশ সৃষ্টি আন্দোলনের অসংখ্য আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতীয় চার নেতাকে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় খুনি মোশতাকের প্রত্যক্ষ মদদে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় বীরদের। বাংলার জনগণ জাতীয় চার নেতার শ্রদ্ধার্থে ৩ নভেম্বরকে জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি জাতীয় রাজনীতিতে এসেছিলেন গাজীপুর থেকে; সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি এসেছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে, এম মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তিনি এসেছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে, এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনি এসেছিলেন বৃহত্তর রাজশাহী থেকে।

বাংলাদেশের চারপ্রান্ত থেকে তারা এসেছিলেন মহীরুহের ন্যায় এবং জ্বলে উঠেছিলেন দেশমুক্তির মহান প্রয়াসে। চার নেতার উপযুক্ত শিক্ষক তথা আলোর মশাল হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ হতে শুরু করে মৃত্যুঅবধি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তারা এবং জীবন দিয়ে আদর্শকে লালন করেছেন। স্রোতস্বিনী নদীর মতোই তারা বহমান ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন বাঙ্গালি জাতিকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় চার নেতার ভূমিকা অত্যন্ত ঈর্ষণীয় পর্যায়ে ছিলো বিধায় দেশি বিদেশী চক্রান্ত উৎ পেতে ছিল, কখন কিভাবে তাদেরকে বাংলার মাটি থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। কারণ, স্বাধীনতার পরে পরাজিত সৈনিকরা আবার একত্রিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতাকে হরণ করতে চেয়েছিলো। সেই সুবাধে বিদেশি পরাজিত সৈনিকরা এ দেশীয় দোসর দালালদের সাথে সন্ধি স্থাপন করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলো। আমেরিকা, পাকিস্তান আরো অনেক দেশের সাথে শত্রুপক্ষ ষড়যন্ত্র করে ৭৫ এর নির্মম হত্যাকান্ড ঘটায়।

৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর আমরা দেখেছি খুনি মোশতাকের মন্ত্রীসভায় বঙ্গবন্ধু সরকারের অনেক মন্ত্রীই দায়িত্ব নিয়েছেন এবং নানাভাবে সরকারের সাথে থেকেছেন। আবার অনেকেই সরকারের রোষানল থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশত্যাগ করেছিলেন কিংবা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেছেন। আবার, নানামুখী চাপ থাকা স্বত্ত্বেও অনেক নেতাই সরকারের প্রস্তাবে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জাতীয় চার নেতা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার স্বরূপ খুনি সরকারের হাতে জীবন দিয়েছেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালে কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, ১৯৬৬-৬৯ সাল পর্যান্ত তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

দেশ স্বাধীনের পর তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এবং শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করেন। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে তিনি নতুন দলটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যান্ত বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের প্রতি অটুট থেকে জীবন দিয়ে দেশপ্রেমের মহাত্ন প্রমাণ করে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পট পরিবর্তনের পর খন্দকার মোশতাক ও দোসররা চেয়েছিলেন দেশকে পাকিস্তানের প্রেতাত্না হিসেবে তৈরি করতে, তাই দেশপ্রেমিক বাঙালিদের হত্যার নীলনকশা চূড়ান্ত করেছিলেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সেই ষড়যন্ত্রের শিকার।

তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯২৫ সালে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কোরআনের হাফেজ তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে কাপাসিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন এবং ১৯৭০ সনের নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে তাজউদ্দিন হয়ে উঠেন অনন্য।

তার সঠিক দিক নির্দেশনায় বাংলার মানুষের মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলন বেগবান হয় এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির স্বপক্ষে তিনি বর্হিবিশ্বের নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তাজউদ্দিন আহমেদ কেও নানাভাবে প্ররোচনা দেখানো হয়েছিল কিন্তু তিনি ছিলেন রাজনীতির কাঠপোড়ানো সৈনিক। তাইতো শাসকের বুলেট তাজউদ্দিন আহমেদকে বিদ্ধ করেছিল তারপরেও তিনি নীতি আদর্শের পথ থেকে বিচ্যুত হননি।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ১৯১৯ সালে সিরাজগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হন। ১৯৫৬ সালে আইন ও সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে ও সাধারণ পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা, ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে তিনি বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়ের দৃষ্টান্ত বাকি ৩ নেতার সাথে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তাকে জেলে হত্যা করা হয়।
মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯২৬ সালে নাটোরে জন্মগ্রহণ করেন; ১৯৬২, ১৯৬৬ সালে পরপর দুবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭০ সনের নির্বাচনেও এমপি মনোনীত হন। আওয়ামী লীগ অান্ত:প্রাণ এই নেতা মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল বিভ্ন্নি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অশেষ শ্রদ্ধা এই নেতার প্রতি, জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যান্ত নিজ দল এবং দলের নীতির সাথে বেঈমানি করেননি। খুনি চক্রে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়েছেন, কোনভাবেই যখন রাজি করানো যাচ্ছিলো না ঠিক তখনি জালেম সরকার অন্যায়ভাবে জেলে আটকে রেখে নির্মমভাবে হত্যা করে এই মহান নেতাকে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোশতাক সরকার কেন ৪ নেতাকে হত্যা করলো? সহজ উত্তর হলো: বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত নেতারা যে কোন সময় সাধারন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার সহ অবৈধ সরকারের পতন ঘটাতে আন্দোলন ঘটাতে পারেন। কারণ, মোশতাক জানতো; মেধা, প্রজ্ঞা, মনন, দেশপ্রেম এবং দায়িত্বশীলতায় এই নেতারা অনন্য। নিজের জীবন গেলেও সত্যের অনুসন্ধান তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে কোন মুল্যে তারা বদ্ধপরিকর।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত নেতাগণ কোন উপঢৌকনে কিংবা পদের লোভে নিজের ভেতরে লালিত মূল্যবোধকে বিলুপ্ত হতে দেয়নি। সে সময় অনেক নেতাই কিন্তু মোশতাকের সরকারে বা বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি নিয়েছেন, কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন এই ৪ জন, জীবন দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন আপোস না করেই। এই মহান নেতাদের প্রতি আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

জাতীয় ৪ নেতাকে স্মরণ বা জেল হত্যা দিবসকে পালনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় সভা সমাবেশ করা হয়। এ সব আলোচনায় অনেক অনুষ্ঠানেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ৪ নেতার পরিবারের সদস্যকে একসাথে করে সেভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন খুব একটা চোখে পড়েনি আমার; হয়তবা হয়েও থাকতে পারে যা আমার জানা নেই।

বর্তমানে অনেকেই মায়াকান্না করেন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু এসব নেতাদের পরিবারের সদস্যরা সেই সময়ে আত্নগোপন করেছিলেন কিংবা সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। অনেকেই অবশ্যই বলে থাকেন, পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁরা তেমনটি করেছিলেন, আমার কথা এখানেই চার নেতাও কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়েও নিজের আদর্শকে বিলীন করে দেননি। তাই এই ৪ নেতার পরিবারকে যত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, দেশ তত বেশি উপকৃত হবে।

কয়েকদিন আগে বঙ্গতাজের ছেলের স্যুটকেশ নিয়ে বিমানবন্দরের কর্তাদের আচরণ সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাকে খুবই আশাহত করেছে। কারো লাগেজের তালা ভাঙ্গা কিংবা চেক করার পূর্বেই অবশ্যই অনুমতি প্রয়োজন, সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের সাথে এমন অযাচিত আচরণ বড্ডই বেমানান। আওয়ামী লীগ সরকার ৪ নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক মাঠে যতটা গুরুত্ব দিবে ততই দলের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।

কারণ এই ৪ নেতা আওয়ামী লীগের সাথে কখনোই বেঈমানি করেনি, ইত্যবসরে তার পরিবারের সদস্যরা করেননি। পরিশেষে, জাতীয় ৪ নেতার জীবনী বই পুস্তকে বিশদ আকারে অন্তুভূক্ত করার দাবি জানাচ্ছি যার প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের জীবনী থেকে নিজের জীবনে দেশপ্রেমের মন্ত্র প্রয়োগ করতে পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Exit mobile version