চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর গোলাম কিবরিয়া

ইমাম মাহদী
বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, গোলাম কিবরিয়া, ব্যারিস্টার আব্দুর চৌধুরী, মো. নুরুল হক, জহিরুল হক রাজা মিয়া, আহসান উল্লাহ, ডা. আসাবুল হক, আজিজুর রহমান আক্কাসসহ আরো কয়েকজন ব্যক্তি ছিলেন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার স্বাধীকার আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাজনীতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। বিশেষ করে স্বাধীনতার ইতিহাসে খোকসা কুমারখালীর রাজনীতির প্রাণপুরুষ ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গোলাম কিবরিয়ার নাম স্বর্ণাক্ষরের ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

১৯১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বাটিকামারা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন শহীদ গোলাম কিবরিয়া। পিতার নাম ফকর উদ্দীন মুন্সী, মাতা কুনু বিবি। কুমারখালী দাখিল মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। ১৯৩৬ সালে কুমারখালীর ঐতিহ্যবাহী এমএন হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। ১৯৩৮ সালে ইংরেজিতে গোল্ড মেডেলসহ কৃত্তিত্বের সহিত উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশোনা অবস্থায়ই গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। মূলত তারই হাত ধরেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন গোলাম কিবরিয়া।

Bkash July

জানা যায়, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পর তখন ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হওয়ার রাজনীতিতে উদ্দীপ্ত। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র, রাজনীতি আর নেতৃত্ব নিয়ে তখন রাজনীতির মাঠে নতুন মেরুকরণ। এইসময়ই তরুণ গোলাম কিবরিয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে তিনি কোলকাতার শিয়ালদহ রেলওয়েতে স্টেশন মাস্টার হিসেবে চাকুরি পেয়েছিলেন। চাকুরত অবস্থায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে মতনৈকট্য দেখা দিলে তিনি চাকুরি ছেড়ে চলে আসেন নিজ এলাকায়। পুরোদমে রাজনীতে প্রবেশ করেন।

গোলার কিবরিয়ার প্রয়াত সহধর্মিনী নূরজাহান বেগম এক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছিলেন,‘কুমারখালী রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ আম গাছের নিচে বেশ কিছু অসহায় পরিবার এলোমেলো ভাবে বসে আছেন। সালটা ১৯৪৭ দেশ বিভাগের পর নিজস্ব বাড়ি ঘর ছেড়ে রেখে নিরুপায় হয়ে ওপার বাংলায় চলে আসা মানুষগুলোকে নজরে পরলো তার। অকল্পনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তিনি এক এক করে তাদের আশ্রয় দিলেন কুন্ডুপাড়া ও এলঙ্গী পাড়াতে।’
গোলাম কিবরিয়া বয়সে বঙ্গবন্ধুর বড় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় গোলাম কিবরিয়াকে মিয়া ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধু ও গোলাম কিবরিয়া দুজনারই রাজনৈতিক গুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে গোলাম কিবরিয়ার আর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম একই সঙ্গে রাজনীতি করতেন। তাদের মধ্যে ছিলো সুসম্পর্ক।

Reneta June

গোলাম কিবরিয়া সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের লেখক, সাবেক মন্ত্রী ও বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যরিস্টার আমীর-উল ইসলামের ভাষ্য, ‘পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম থেকেই গোলাম কিবরিয়া সাহেব মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। কুমারখালীতে তাঁর সামাজিক অবস্থা মজবুত ছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে তাঁর একটা শক্ত ঘাটি ছিল। পরবর্তী সময়ে গোলাম কিবরিয়া আওয়ামী লীগে যোগ দেন। যখন আওয়ামী লীগ গঠন হয় তখন গোলাম কিবরিয়া ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা ছিল। গোলাম কিবরিয়া গোড়া মুসলিম লীগ ছিলেন। মুসলিম লীগ থেকে তিনি আওয়ামী লীগে আসেন।

বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দিলেন তখন এ বিষয়টার প্রতি সবার মনযোগ আকর্ষণ হয়। ছয় দফার মধ্য দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছয় দফার মধ্য দিয়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। আইয়ুব বিরোধী ওই আন্দোলনে যোগদান করেন গোলাম কিবরিয়া এবং বেগম ফাতেমা জিন্নাহ’র নির্বাচনের সময় আমরা যেসব জায়গায় গিয়েছি সেখানে আমাদের সাথে কাজ করেছেন।’

২০২০ সালের ১৫ আগস্ট ‘মুক্তদেশ’ থেকে প্রকাশিত লেখক ও গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ গিয়াস উদ্দীন আহমেদ মিন্টু তার রচিত ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ৫৯ পৃষ্ঠায় গোলাম কিবরিয়ার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন,

‘৬৭’র গোড়ার দিকে এবং বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বের সময়টাতে তিনি কুষ্টিয়া এসেছিলেন। কর্মীসভা হয়েছিলো ‘মোহনী মোহন বিদ্যাপীঠ স্কুল’ সংলগ্ন অডিটোরিয়ামে। খুব সম্ভবত ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কাজী কফিল উদ্দিন মোক্তার)। শহীদ গোলাম কিবরিয়া ঐ কর্মীসভায় ‘ছয়দফা’র পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থণ জানিয়েছিলেন।’ ৭২ পৃষ্ঠায় গোলাম কিবরিয়ার রাজনৈতিক বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, ৭০-এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ১ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া আসেন। সাথে ছিলেন জাতীয় চার নেতা। তিনি ভেড়ামারা মিরপুর আমলা খলিসাকুন্ডি, গাংনী, মেহেরপুর পথাসভা শেষে সন্ধ্যার পরপর কুষ্টিয়া ডাকবাংলোতে বিশ্রাম করেন। পরে তিনি রাত্রি ৭-৮ টার দিকে পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে’র গণজমায়েতে বক্তৃতা করেন। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আক্কাস। ঐ সভায় শহীদ গোলাম কিবরিয়া এক বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে জমায়েতে এলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাদরে আলিঙ্গন করেন এবং এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও শহীদ গোলাম কিবরিয়াকে যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ সদস্য পদপ্রার্থী ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।’

১৯৬৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুমারখালীর স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ নির্মাণ করা হয় কুমারখালী জেএন হাইস্কুল মাঠে। এই শহীদ মিনার নির্মানের অন্যতম রুপকার ছিলেন গোলাম কিবরিয়া। শহীদ মিনার তৈরির তিনদিন পরে ২১ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে উদ্বোধন করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু জীবদ্ধশায় ১৯৬৬ সালের আগে ও পরে দুইবার এসেছেনে কুমারখালী এই গোলাম কিবরিয়ার বাড়িতে। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে খোকসা কুমারখালী আসন থেকে আওয়ামী লীগরে মনোনয়নে নিবার্চনে প্রাথী হন গোলাম কিবরিয়া। নির্বাচনে গোলাম কিবরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সৈয়দ আহমেদ পেয়েছিলেন ৬ হাজার ২৩৭ ভোট। অন্যদিকে গোলাম কিবরিয়া ৬১ হাজার ৪০৭ ভোট পেয়ে বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে পাকিস্তান দিবসের বদলে ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালন করা হয়। এসভায় সভাপতিত্ব করেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন বৃহত্তর জেলা ছাত্রলীগরে সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আব্দুল জলিল। এসময় দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হাদী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ মারফত আলীর নেতৃত্বে কুচকাওয়াজে প্রথম সালাম গ্রহণ করেছিলেন গোলাম কিবরিয়া ও আব্দুর রউফ এমপি।

গোলাম কিবরিয়া সম্পর্কে ইতিহাসের এই কিংবদন্তি ছাত্রনেতার ভাষ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। প্রয়াত গোলাম কিবরিয়া তখন এমপি। বয়সে বঙ্গবন্ধুর বড় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। খোকসা কুমারখালীর রাজনীতিতে গোলাম কিবরিয়ার অবদান যথেষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি করিমপুর ক্যাম্পের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধেও তার অবদান ও অংশ্রহণ ছিলো সক্রিয়ভাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমার সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। কুমারখালীর রাজনীতিতে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো।’

গোলাম কিবরিয়াকে উদার মনের মানুষ আখ্যা দিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উুল ইসলাম তাঁর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি যখন কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই তখন গোলাম কিবরিয়া সাহেবকে অন্যতম সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কুমারখালী অঞ্চলে তাঁর ছিল একটা মজবুত ঘাটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমারখালী অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। এতে গোলাম কিবরিয়া সাহেবের অবদান ছিল অসামান্য। ওই সময় পদ্মা পেরিয়ে পাবনার মানুষ এসেছিল কুমারখালী। অসহায় সেসব মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সবরকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে তারা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আমি যখন যায় তখন দেখি কিবরিয়া সাহেব তার লোকজন নিয়ে কৃঞ্চনগর অঞ্চলের দিকে থাকতেন। কুমারখালী-খোকসার লোকজন যে সমস্ত জায়গায় ছিলেন তাদের কাছাকাছিই থাকতেন। তাদেরকে রিফুজি ক্যাম্পে (শরণার্থী শিবির) না পাঠিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সংগঠক হিসেবে কিবরিয়া সাহেব অনেক দক্ষ, ভাল ছিলেন। সাধারণ মানুষের সাথে ছিল খুব সাবলীল, সহজ-সরল সম্পর্ক। তিনি সব ধরনের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। সবাইকে সবরকম সহযোগিতা করতেন। ‘গোলাম কিবরিয়া বয়সে আমার বড় ছিলেন। আমাদের একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। যে সম্পর্কে তাঁকে আমি ‘নানা’ বলে ডাকতাম। আমাদের আড়–য়াপাড়ার সাথে তাঁর একটা যোগাযোগ ছিল। আড়–য়াপাড়া আমার নানাবাড়ি।’

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও জনগনের সাথে গোলাম কিবরিয়ার সম্পর্ক ও অধিকার সম্পর্কে প্রয়াত সহধর্মিনী নূরজাহান বেগমের ভাষ্য,
‘মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অবস্থা একেবারেই শোচনীয় ছিলো সবাই খাদ্যাভাবে ভুগছিলেন। ঠিক সে সময় কুমারখালীর উপর দিয়ে চাল ভর্তি ট্রেনের বগি যাচ্ছিলো। সে সময় শহীদ গোলাম কিবরিয়ার নির্দেশ এক বগি ভরা চাল নিয়ে নেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্য। এ খবর শোনার পর তৎকালীন ডিসি সাহেব শহীদ গোলাম কিবরিয়াকে চাল ফেরত দিতে বলেন কিন্তু আমার দাদা অস্বীকৃতি জানায়। তখন ডিসি সাহেব নিরুপায় হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে নালিশ করেন। তার সব কথা শোনার পর জাতির পিতা বললেন তাকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আমার নেই।’

স্বাধিকার আন্দোলন থেকেই গোলাম কিবরিয়া কুষ্টিয়া জেলায় নিজের গ্রহণ যোগ্যতা তৈরি করেছিলেন তার রাজনৈতিক গুণাবলি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের সাথেও ছিলো কুমারখালীর কিবরিয়া পরিবারের অত্যন্ত সখ্য। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ডাঁশা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধকালীন গেরিলা কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান মাস্টার সাক্ষাৎকালে জানান, ‘বঙ্গবন্ধু যখন ছয়দফা দাবি পেশ করেন তখন গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে কুষ্টিয়া, খোকসা কুমারখালীতে এই ছয়দাফর পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমার দীর্ঘ জীবনে গোলাম কিবরিয়া ছিলেন আমার অভিভাবক। একাত্তর সালে ভারতে গেলে থাকা, খাওয়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছেন। পরবর্তীতে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য আমার বাহিনীকে অস্ত্রও দিয়েছেন।

দেশ স্বাধীনের পরে তিনিই আমাকে নিয়ে ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্য। ১৯৭৪ সালে গোলাম কিবরিয়াকে ঈদের নামাজে প্রকাশ্যে হত্যা করার মধ্য দিয়ে খোকসা কুমারখালী থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে। আর ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বপ্ন ও চেতনাকে ধ্বংশ করা হয়েছে। তার ছেলে সাবেক এমপি মরহুম আবুল হোসেন তরুণের সাথে ছিলো আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।’

গোলাম কিবরিয়া সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খোকসা উপজেলার রমানাথপুর গ্রামের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেকে এক সাক্ষাৎকারে বিবরণ দিয়েছেন, ‘এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুমারখালীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম গোলাম কিবরিয়া এমপি মহোদয় ভালুকার আব্দুল জলিলের মাধ্যমে গণেশপুরের আব্দুল গনি জোয়াদ্দারের কাছে ১১টি ৩০৩ রাইফেল পাঠাইয়া দেন। গনি জোয়াদ্দার ও আব্দুল গফুর মোল্লা তখন স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাইফেলগুলো মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলেন। আমি ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পর এলাকায় এসে আলী হাসান ও আব্দুস ছাত্তারের সহযোগিতায় রাইফেলগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিতরণ করি।’৭

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গোলাম কিবরিয়ার অবদান সম্পর্কে কুমারখালী উপজেলার দক্ষিণ মুলগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন জানান, ‘শহীদ গোলাম কিবরিয়ার ছেলে আলতাফ হোসেন কিরনের সাথে ছিলো আমার খুবই ভালো সম্পর্ক। তার ধরেই গোলাম কিবরিয়ার সাথে আমার পরিচয় ছিলো। আমরা তার নেতৃত্বেই ভারতে অবস্থান করি এবং প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও খোকসার কুমারখালীর আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে গোলাম কিবরিয়ার অবদান অসামান্য।’

মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠক গোলাম কিবরিয়া ছিলেন কুমারখালী আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি খোকসা কুমারখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কুষ্টিয়া, কুমারখালী ও খোকসার রাজনীতিতে গোলাম কিবরিয়া পরিবারের একটি এতিহ্যবাহী সুনাম রয়েছে। কারণ রাজনীতিরি মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা।

রাজনৈতিক কারনে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও জাতীয় চার নেতার সাথেও ছিলো তার পারিবারিক সুসম্পর্ক। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর কুমারখালীর বড় জামে মসজিদ ঈদগাঁ মাঠে ঈদের জামাতে নামাজরত অবস্থায় চরমপন্থিদের গুলিতে তিনি নিহত হন। পরবর্তী সময়কালে তার সুযোগ্য সন্তান আবুল হোসেন তরুণ এই আসন থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিও প্রয়াত হলে আবুল হোসেন তরুণের সহধর্মিনী ও শহীদ গোলাম কিবরিয়ার পুত্রবধু বেগম সুলতানা তরুণও ২০০৮ সালে সংসদ্য সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গোলাম কিবরিয়ার পৌত্র ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ খোকসা কুমারখালী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। গোলামি কিবরিয়ার আরেক ছেলে শামসুজ্জামান অরুণ বর্তমানে কুমারখালী পৌরসভার মেয়র।

পারিবারিকভাবেই গোলাম কিবরিয়ার হাত ধরে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে প্রবেশ এই কিবরিয়া পরিবারের। সেই সূত্র ধরেই বর্তমানেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিবারের সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিলো শহীদ গোলাম কিবরিয়াও সেই নির্বাচনে খোকসা কুমারখালী থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাত্তর সালের ০৩ জানুয়ারি রমনার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোওরাওয়ার্দী উদ্যান) আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৪১৯ জন শপথ গ্রহণ করেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু। শহীদ গোলাম কিবরিয়াও বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণকারী সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহচর। বাংলাদেশের সংবিধানের সিগনেটরি মেম্বারও ছিলেন তিনি। বয়সে বঙ্গবন্ধুর বড় হওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁকে মিয়া ভাই বলে সম্বোধন করতেন।

সংসার জীবনে গোলাম কিবরিয়া ছিলেন সাত ছেলে ও পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততোদিন বেঁচে থাকবেন এই কীর্তিমান মানুষ ও তার স্মৃতি। স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামীলীগ ও খোকসা কুমারখালীর রাজনীতিতে তার এই অসামান্য অবদান জাতি শ্রদ্ধাভারে স্মরণ করে। তৃণমূলের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক মহান পুরুষ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View