ডিসেম্বরে ক্যালেন্ডারে প্রতি বছরই ঘুরে ফিরে আসে। গোটা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন অসংখ্য, অগণিত ডিসেম্বর ৩৬৫ দিন পর পর।
আমাদের কাছে ডিসেম্বর একটাই একাত্তরের ডিসেম্বর। এই একাত্তরের ডিসেম্বর প্রতিবারই ঘুরে ফিরে আসে স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস হিসেবে। এবারের ডিসেম্বরে বাঙালির জীবনের একটা ভিন্ন স্বাদ আছে। বিজয়ের স্বাদ-বেদনার স্বাদ। না, আমি একাত্তরের দিনগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধরত সশস্ত্র যোদ্ধাদের মৃত্যুজনিত ঘটনাকে বেদনার বলে অভিহিত করছি না-বরং ঐ মহান মৃত্যুগুলিই তো জাতিকে এনে দিয়েছিল স্বাধীনতা-রক্তাক্ত স্বাধীনতা।
কিন্তু তা হলে আবার বেদনারও বলছি কেন? বেদনার এ কারণে অসংখ্য মানুষ-যাঁরা যুদ্ধে যান নি-দেশও ছাড়েন নি-হাজারো কষ্ট ও নিরাপত্তাহীনতাকে সার্বক্ষণিক সাথী হিসেবে নিয়ে নতুন দিনের প্রত্যাশায় দিন গণনা করেছেন-যাঁরা বনে-জঙ্গলে-ঝোপে-ঝাড়ে সন্ধ্যায় অন্ধকারে একটি ব্যাটারী চালিত বেতারযন্ত্র হাতে নিয়ে অত্যন্ত প্রতিটি সন্ধ্যায় একটি অন্ধকার ঝোপের মধ্যে বসে কান পেতে বিবিসি আকাশ বানীতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক খবর শুনেছেন-অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিন্তু রাত ১০ টার পরে বাড়ি ফিরে গিয়ে পেটের ভাতটুকু জোটেনি, স্ত্রীর বা মেয়ের পরনে থেকেছে শতছিন্ন শাড়ী-তবু তাদেরকে নিয়ে বাড়িতে বসে বেতার শুনা খবরগুলি জানিয়ে সুদিন আসছে-সুদিন আসছে বলে বাড়ির সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন-আর ক’টা দিন অপেক্ষা করে সেই সুদিনকে স্বাগত জানাতে বলেছেন-তাঁরা স্বাধীনতার নামে একটি নতুন মানচিত্র, নতুন লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা আর জীবন ধন্য করা নতুন একটি জাতীয় সঙ্গীত পেলেও আজ এই দীর্ঘ ৫০টি বছরেও পেটের ভাতের, সন্তানের কাজের, মেয়ের নিরাপদে পথ চলার নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে।
আমরা যেদিন দেশে ছিলাম না-দেশের কাজেই পাশের দেশ মুজিবনগরে গিয়ে অসংখ্য যুব শিবির গড়ে তুলেছি বিশাল সীমান্ত এলকা জুড়ে, দেশত্যাগী হাজার হাজার তরুণকে ঐ যুব শিবিরগুলিতে বিক্রুট করে ভারতের মহানুভূতিশীল সেনা-অফিসারদের হাতে তুলে দিয়েছি অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য-আবার প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এলে নানা ধরণের অস্ত্র, বোমা প্রভৃতি দিয়ে অসংখ্য গ্রুপে বিভক্ত করে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাঠিয়েছি শত্রু নিধন করতে, নারীর সম্ভ্রম ও সকল পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। অনেক তরুণকে অকালে হারিয়েছি-তারা বীরের মত লড়াই গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেককে মা-বাবাই যুদ্ধে যেতে সম্মতি দিয়েছিলেন সুদিনের প্রত্যাশায় আবার অনেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন নতুন পতাকা হাতে নিয়ে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-প্রেমিকার চোখে মুখে হাসি ফুটাবেন কিন্তু তাঁদের আর কোন দিনই পাওয়া গেল না-এমন সব পরিবারকে আমরা গর্বিত পরিবার বলি বটে কিন্তু সোনার ছেলেটিকে হারিয়ে তাদের দারিদ্র্য মেটানো এবং সংসারের দায়িত্ব পালন কে ক রবেন-যাঁরা এমন চিন্তায় ভারাক্রান্ত তঁঅদের কাছে সন্তানের এই আত্মদান কি অর্থবহ হয়েছে?

একটি মুক্তিযোদ্ধা গেজেট এবং মাসিক মাত্র ২০,০০০ টাকার ভাতা কি ঐ শহীদদের বা যোদ্ধাদের বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের জীবনে দীর্ঘকল ধরে ধারণ করা দারিদ্র্যমুক্ত জীবন পাবার প্রতাশা পূরণ করেছে।
আমি বোধ হয় ভাবাবেশে তাড়িত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে কিছু নেতিবাচক দিককে তুলে ধরেছি। না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার সুবর্ণ জয়ন্তী শুধুমাত্র কোন নেতিবাচক বিষয় নয় বরং তা বহুল পরিমাণেই ইতিবাচক।
আমরা কি পাকিস্তান আমলে কদাপি ভাবতে পারতাম, স্বাধীনতা-বিরোধীরা শাস্তি পাবে? পেয়েছে। শুধু শাস্তিই হয় নি, ফাঁসির কাঠেও ঝুলেছে। যে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এই মহান মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের পরাজয়, ৯৩,০০০ উচ্চ প্রশিক্ষিত পাক-সেনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমপর্ণ সেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনে জনগণকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলিকে ১৯৭২ এর সংবিধান উপহার দিয়েছেন যাতে পূর্ব প্রদত্ত তাবৎ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন বা স্বীকৃতি দিয়ে তা পালনের জন্যে ভবিষ্যত কর্ণধারদের জন্য রেখে গেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে পাকশীর বিধ্বস্ত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সংস্কার, ভেঙ্গে ফেলা (যুদ্ধকালে) অসংখ্য রাস্তাঘাট ও সেতু পুনঃনির্মাণ করে মানুষের চলাচলের উপযোগী করে তোলা, কৃত্রিম একটি দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা, শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে আনা-সশস্ত্র নকশাল-জাসদ-রাজাকার-আলবদরদের মোকাবিলা করে মোটামুটি শান্তিশৃংখলা ফিরিয়ে আনা-বিধ্বস্ত কৃষিক্ষেত্রগুলিকে সজীব করে তুলে কৃষক সমাজের আশু সমস্যা মেটানোর কাজে উদ্যোগী হওয়া, আবাদী জমির সিলিং নির্ধারণ করা, শিল্প কারখানাগুলিকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে এসে বস্তুত: দেশের অগ্রগতি সাধনে এক বৈপ্লবিক যাত্রার সূচনা করেন। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সকল সচেতন মানুষের আকাংখা পূরণে অগ্রসর হন। সেই যে বঙ্গবন্ধুর অবদান তাঁর স্বল্পকালীন রাষ্ট্র পরিচালনাকালে ইতিহাসে তা স্মরণীয় হলেও আজ, এই ডিসেম্বরে, এই মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর ঐতিহাসকি লগ্নে-তা কি আমরা সম্মানের সাথে রক্ষা করেছি?
জমির সিলিং উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, শিল্প কারখানাগুলির বিরাষ্ট্রীয়করণ করে তা মুষ্টিমেয় ধনিক বণিকের হাতে তুলে দিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিম্মতম মঞ্জুরী অনির্ধারিত রেখে অর্থনৈতিকভাবে তাদেরকে অসহায় করে তোলা হয়েছে, যখন-তখন মালিকের খাম-খেয়ালীমত শ্রমিকদের চাকুরীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার আশংকা সৃষ্টি করা হয়েছে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি রীতিমত বৈধ করে দিয়ে একাত্তরের শহীদদের ও তাদের পরিবার সহ লাখো পরিবারের নিরীহ মানুষগুলিকে নির্মমভাবে হত্যাকারী জামায়াতে ইসলামী আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, হেফাজতে ইসলাম নামক আর এক ভয়াবহ জঙ্গী সংগঠনের জন্ম দিয়ে তাদের আকাংখামত শিক্ষানীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে, নারী জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে স্বাধীন মত প্রকাশ করায় স্বাধীন-চেতা স্পষ্টবাদী লেখকদের অনেককে হত্যা ও অনেককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখ প্রাঙ্গনে নির্মিত ভাস্কর্য্যকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয় চাপ সৃষ্টি করে ভাস্কর্য্যটি সুপ্রিম কোর্টের পিছন দিকের প্রাঙ্গনে স্থাপন করিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির মর্য্যাদা ও ঐতিহ্য হরণ করেছে, নির্মাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য প্রকাশ্য দিবালোকে কুষ্টিয়ার রাজপথে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, মাদ্রাসার উচ্চতম ডিগ্রীকে বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রীর সম পর্য্যায়ভূক্ত করাতে সক্ষম হয়েছে।
সর্বাধিক আশ্চর্য ও বেদনার বিষয় যে সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তাঁর একটি বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্ত জানা মাত্র হেফাজত হুমকি দিয়ে বলেছে, ঐ ভাস্কর্য্য নির্মাণ করলে তা ভেঙ্গে তারা বঙ্গোপসাগরের অতল জলে নিক্ষেপ করবে, তখন সরকার নীরবে ঐ সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে; হেফাজতের আমীর পর্য্যায়ের নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কেউ কেউ রাজকীয় হোটেলে নারী নিয়ে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ায় স্থানীয় জনগণ ধরে ফেলে তাকে পুলিশের হেফাজতে দেওয়ায় আজও কেউ কেউ বৎসরাধিক হলো কারাজীবন যাপন করছে।
ভারতের প্রধান মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে তারা ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে যে ব্যাপক তা-ব চালালো সে ব্যাপারে যারা মূল দায়ী তারা আজও নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের এক নেতার অসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ওয়াজের কারণে সুনামগঞ্জের শাল্লায় শত শত হিন্দু বাড়ীঘর দোকানপাট লুট পাট করা হয়েছে, মামলা হলে আসামীদের একাংশকে গ্রেফতার করলেও তাদেরকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জামিনে মুক্তি দিলেও যে তরুণটি ঐ ওয়াজের বক্তব্য ফেসবুকে পোষ্ট করেছিল-তাকে ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনে দীর্ঘ এক বছল ধরে জেল খাটতে বাধ্য হলো-ইত্যাদি।
এ জাতীয় কাহিনীর শেষ নেই। কিন্তু প্রশ্ন করা যেতেই পারে এই ডিসেম্বরে ৫০ বছর আগে যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছিলেন-তাঁরা কি স্বাধীন দেশের এমন পরিণতি কথা আদৌ কল্পনা করতে পেরেছিলেন? অথবা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ও লাখো শহীদ ও ধর্ষিতা নারীর ভাবনায় কি ছিল এমন একটি বাংলাদেশ? ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা লাখে লাখে সর্বস্ব হারিয়ে দেশত্যাগ করে লড়াইতে অংশ নিয়ে যে দেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন-তাঁদের সে আকাংখার এমন পরিণতি কি কদ্যপি কেউ ভেবেছিলেন-মুজিবনগরের তাজউদ্দিন সরকার কেউই কি তা ভেবেছিলেন।
পরিণতি। আওয়াজ আওয়ামী লীগের একাধিক মেয়র ও দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ফুল দিয়ে “বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আল্লাহের কাছে দায়ী হতে পারব না বলে মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। দলীয় ও মেয়র পদ থেকে তাঁদেরকে অপসারণ করা হলেও-আরও যে কতজন গোপনে এমন মত লালন করে, দলটি কি তা পর্য্যালোচনা করছে? এই পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী হেফাজত-জামায়াতের গায়ে কি
এতগুলি অপরাধ সত্বেও এতটুকু আঁচড় পড়েছে? বিসমিল্লাহ, ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির বৈধকরণ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন ভুল হয়েছে” এমন উক্তি ক্ষমতাসীন কোন কোন মন্ত্রী পর্যন্ত করতে শুরু করেছেন।
আশাবাদী হতে চাই এই ডিসেম্বরে মন্ত্রী স্বীকৃত ভুলগুলি সংশোধন করে স্বাধীনতার আকাংখা এবং তার অর্জনকে সব কিছু এড়িয়ে আবারও ঐতিহাসিক পর্য্যায়ে তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীকে অর্থবহ করে তোলা হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)