হাত নাড়াতে শেখার পর থেকেই সম্ভবত: ব্যাটে হাত, দৌড়াতে শেখার পর থেকেই রান।
স্কুলে যাওয়ার আগেই সার্কিট হাউজ মাঠে লিগ দেখতে দেখতে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বাদ ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামে যাকে তখন মারাকানার মতো বড় মনে হতো।
এমসিসি, হায়দ্রাবাদ ডেকান ব্লুজ এরকম দলের সঙ্গে ম্যাচে লাঞ্চের সময় দীর্ঘ মিছিলের মতো মানুষের ভিড়ে বাসায় এসে ভাত-টাত খেয়ে আবার যেতাম।
কল্লোল কচিকাঁচার মেলা বা এরকম কোনো ক্লাব একবার বাটারবন খাইয়েছিলো। বিদেশীদের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ দেখার মতো সেই বাটারবনের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।
আমাদের লোকাল হিরো বেলাল ভাই তখন বাংলাদেশ মধ্যাঞ্চলের প্লেয়ার। সকাল-বিকাল তাকে দেখি তাই হায়দ্রাবাদের জাহিদ নামে একজন নামের মিলের কারণেই হয়তো আরও বড় হিরো। একবার স্টেডিয়ামের কাঁটাতার ডিঙিয়ে তার কাছাকাছি চলে গিয়ে চীৎকার করে বললাম, মাই নেম ইজ জাহিদ। টু-ও বলার দরকার ছিলো, ৭/৮ বছর বয়সে সেটা বোঝার কথা না। মিডঅফ বা মিডঅনে ফিল্ডিং করছিলেন তিনি। আমার চীৎকারে কাছে এসে টফি বা চুইংগাম দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেটা খাইনি। পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি অনেকদিন।
এরপর বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে দেখা টেলিভিশনে। ৮৬ সাল হবে সম্ভবত:। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিলো শ্রীলংকা। কে কতো রান করেছিলো মনে নেই, রেকর্ড দেখলেই জানা যাবে। কিন্তু মনে আছে ১০০র কিছু বেশি রান করা, হতে পারে ১৩২, বাংলাদেশ অলআউট যে হয়নি এটাই ছিলো আমাদের কাছে গৌরবের।
আরো পরে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের সম্ভাবনা জেগেছিলো ৯০ দশকের শুরুর দিকে, শারজাতে এশিয়া কাপেই হবে হয়তো। এবারও প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা। প্রথম বলেই বোধহয় উইকেট পেয়েছিলেন সাইফুল, ক্যাচ ধরেছিলেন বুলবুল। ওই ম্যাচে যতোদূর মনে পড়ে ২১২ রানে বুকড হয়েছিলো শ্রীলংকা। কিন্তু আমরা অলআউট হয়ে যাই ১৮৭ বা ১৮৮ রানে। শেষের দিকে অসাধারণ এক দৌড়ের ওপর একটা ক্যাচ নিয়েছিলেন ভাস।
জয়ের সম্ভাবনা এসেও এই হারিয়ে যাওয়াটা দেখা টেলিভিশনে। আর সামনাসামনি এরকম সম্ভাবনা এসে মিলিয়ে যাওয়াটা দেখা এখনকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। বৃৃষ্টিতে সম্ভবত: ৩৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে জিম্বাবুয়ে ১৩৬/৩৭/৩৮ এরকম রান করেছিলো।
শেষ বলে বাংলাদেশের জয়ের জন্য বোধহয় ২ রানের দরকার ছিলো। বোলার ছিলেন হিথ স্ট্রিক, ব্যাটিংয়ে আমাদের পেসার জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার দুলু। কিন্তু হয়নি। আগেই বেরিয়ে যাওয়ার কারণে দুলুর উইকেট গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন আমাদের এখনকার বোলিং কোচ স্ট্রিক।
তবে এ হারের চেয়েও পরাজয়ের জ্বালা বেশি হয়েছিলো রেডিওতে শোনা নাইরোবির সেই ম্যাচ যেটা হেরে আমরা ৯৬ বিশ্বকাপ খেলতে পারলাম না।
তবে ধীরে ধীরে ততোদিনে কিন্তু আমরা পরিণত হতে শুরু করেছি। ৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াও খোঁজখবর শুরু করলো। ইউএনবিতে শখের বশে দুয়েকটা ক্রিকেট রিপোর্ট করার কারণে আমাকে খুঁজে নিলো ক্রিকইনফো।
তার চেয়েও ভয়ংকর বিষয় ঘটলো ৯৯ বিশ্বকাপের আগে। আমার কাছে অফিশিয়াল স্যুভেনির কমিটি লেখা চেয়ে বসলো। অন্য লেখকদের নাম মনে করলে এখনও লজ্জায় মরে যাই। লেখক তালিকায় ছিলেন সুনীল গাভাস্কার, ম্যালকম মার্শাল, ব্যারি রিচার্ডস; এরকম বিখ্যাত সব ক্রিকেট লিজেন্ডস।
অন্যরা এনালিসিস দিলেও আমার লেখা ছিলো রিপোর্টের মতো। ইতিহাস সাক্ষী, তখনকার বিসিবি প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীকে কোট করে আমি লিখেছিলাম, স্কটল্যান্ড ছাড়া আরও একটি দলকে হারিয়ে চমক দেখাতে পারে বাংলাদেশ।
সেই গৌরব এসেছিলো পাকিস্তানবধের মাধ্যমে। ওই রাতে আমরা পরে গাবতলী গিয়ে গরু কিনে এনেছিলাম।
পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক জয়ের পথ ধরেই টেস্ট স্ট্যাটাস। পনেরো বছরে আজকের অবস্থায় বাংলাদেশ। ঘরের মাটিতে টানা ১০ ম্যাচে জয় আমাদের। পাকিস্তানের পর প্রথমবারের মতো ভারতের সঙ্গে সিরিজ জয়। র্যাংকিংয়ে ৭ নম্বরে যাওয়ার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করেছি।
আর সোনা রোদের আলো হয়ে এসেছে মুস্তাফিজ যেখানে সূর্যের মতো মাশরাফি, চাঁদের আলো হয়ে সাকিব-মুশফিক-তামিম।
আজ যখন বিস্ময় আনন্দে আমরা ভেসে যাচ্ছি তখন প্রেক্ষাপটটাও মনে হচ্ছে। এসব কিছুই হঠাৎ পাওয়া নয়। আসলে আমাদের বেড়ে উঠার গল্পের মতোই ক্রিকেটে আমাদের উত্থান। এক মুস্তাফিজই তাই শেষ নয়। পূর্ব প্রজন্ম যে ভিতটা দিয়ে গেছে, যে পরিবেশটা নিশ্চিত করে গেছে, সেখানে আরও মুস্তাফিজ, আরও সাব্বির, আরও সৌম্যরা আসতেই থাকবে।
ভারত-পাকিস্তানই তাই শেষ নয়, টাইগারদের নান্দনিক থাবায় শিল্পিত ক্ষত-বিক্ষত হবে অন্যসব ক্রিকেট পরাশক্তিও।
আমাদের সমান বয়সী বাংলাদেশের যে ক্রিকেট, দর্শক হিসেবে আমরা যে ক্রিকেটকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজকের অবস্থায় দেখছি, সেই ক্রিকেটের উত্তর প্রজন্ম নিশ্চিত বিশ্বকাপ দেবে আমাদের পরিণত বয়সের আগেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)