পকেটে ছিল মাত্র ১৩ হাজার টাকা, কিন্তু সাহস আর স্বপ্ন তার বুকভরা। অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে সাত পাঁচ না ভেবে এক স্বপ্নবাজ তরুণ ঝাপিয়ে পড়েন এক মানবিক লড়াইয়ে। যে লড়াই চলে টানা ১০০ দিন। আর এসময়ে পেয়েছেন ভাসমান মানুষদের হৃদয় নিংড়ান ভালবাসা। পেয়েছেন পরিচিত অপরিচিত বহু মানুষের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও শুভ কামনা।
সেই তরুণ হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদ্য সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। যিনি চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের মধ্যে ১০০ দিন ধরে রাজধানীর ভাসমান ছিন্নমূল মানুষদের দু বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।
মার্চ মাসের ২৩ তারিখ থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার (৩০ জুন) শেষ হচ্ছে তার এই কর্মসূচি। এসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মানুষকে এই সেবা দিয়েছেন সৈকত।
এই কর্মযজ্ঞকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা হিসেবে উৎসর্গ করে চ্যানেল আই অনলাইনকে সৈকত বলেন, ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা দেশের জন্য ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তারাই আমার এই কাজের অনুপ্রেরণা। ‘
করোনা মহামারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণার পর সবাই যখন ফিরেছে নিরাপদ নিবাসে, সৈকত তখন রাজধানীর ভাসমান মানুষের কথা ভেবে থেকে যান এই শহরে।
নিজের পরিবার তাকে নিয়ে এই সময়ে দুশ্চিন্তা করেছে কি না, জানতে চাইলে সৈকতের পাল্টা প্রশ্ন, দূর্যোগে-দুঃসময়ে সবাই যদি ঘরে বসে থাকে তাহলে ক্ষুদিরাম হবে কে? তিতুমীর হবে কে?
সৈকত বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। দেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা দেশের মানুষের পাশে ছিল। আমরা জনগনের করের টাকায় এখানে পড়াশোনা করি। জনগনের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকেই আমি এই ভাসমান মানুষদের কথা চিন্তা করি। অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতে পারলে খুব তৃপ্তি লাগে। তাছাড়া আমি শিক্ষার্থীদের নেতা। আমি কাজ করলে সেটির কৃতিত্ব শিক্ষার্থীদেরও।’
তবে এই কাজ করে পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি সৈকত। তিনি বলেন, ‘আমি যদি দেশের সকল ভাসমান ছিন্নমূল মানুষদের দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে তৃপ্ত হতাম।’
আর তাই সৈকতের স্বপ্ন ভবিষ্যতে শ্রমজীবী মানুষদের জন্যই রাজনীতি করবেন তিনি।
এই ১০০ দিনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা সৈকতের হয়েছে যা তাকে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছে। তিনি বলেন, আমি যাদের খাবার দিয়েছি তাদের বেশিরভাগেরই জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। কতোটা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী তারা। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ এই কয়দিন একটিমাত্র কাপড়েই এসেছে খাবার নিতে। যেটি আমাকে তীব্রভাবে ব্যথিত করেছে। ‘
সৈকত বলেন, করোনা উত্তর সময়ে আমি দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে চাই।
তিনি বলেন, গতকাল (২৯ জুন) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাকে ভিডিও কনফারেন্সে বলেন এই কর্মসূচি চালিয়ে যেতে। তিনি (ওবায়দুল কাদের) নিজেও সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। ‘
তবে কিছু আক্ষেপ আর ক্ষোভ রয়েছে সৈকতের। পরিচিত অপরিচিত অনেক পেশাজীবি মানুষের আর্থিক সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে কোন সহযোগিতা পাননি তিনি। বরং অসহযোগিতার অভিযোগ করেন সৈকত।
তিনি বলেন, মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এই কাজ করা অসম্ভব ছিল। অনেক পরিচিত অপরিচিত শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যাংকার, সরকারি চাকুরীজীবি, রাজনীতিবিদ আমাকে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে নানাভাবে অসহযোগিতা করেছেন। তারা কয়েকবার আমার এই কর্মসূচি বন্ধের চেষ্টাও করে। তারা পানির লাইন বন্ধ করে দেয়। গ্যাস ব্যবহার করতে দেয় নি। বাহিরে থেকে খড়ি কিনে রান্না করতে হয়েছে।
সৈকত বলেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই ধরনের মানসিকতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার।
তার ১০০ দিনের কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলেও তিনি ছোট পরিসরে এই সেবা দিয়ে যাবেন। শহরের ভাসমান পাগল, পথশিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের তিনি দুবেলা খাবার দিবেন বলে জানান।