মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের জয়গান গাওয়ার দিন। অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার করার দিন। এদিন শ্রমিক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমের অঙ্গীকারে সচেতনরা আওয়াজ তুললেও মালিক–শ্রমিকের সম্পর্কে এখনো শোষণ–বঞ্চনার কথা শোনা যায় নানা যায়গায়। শ্রমিকদের এসব সংগ্রাম নিয়ে দেশে দেশে নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্র। এসব চলচ্চিত্রে শ্রমিকের কথা বলা হয়েছে, শ্রমিকের অধিকার আদায়ের কথা বলা হয়েছে। তেমনই কিছু চলচ্চিত্র সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
ব্রেড অ্যান্ড রোজেস (২০০০): কেন লোচের এই ছবিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদেরকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এক হতে দেখা গেছে। ছবির গল্প মেক্সিকো থেকে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে আসা দুই অভিবাসী বোনকে ঘিরে। কথায় কথায় কর্মীদের ছাটাই করা হয়। তারা এসবের প্রতিবাদ করে এবং অধিকার আদায়ের জন্য এক হয়।
প্যারাসাইট (২০১৯): বং জুন হো পরিচালিত অস্কারজয়ী সিনেমা প্যারাসাইট। দক্ষিণ কোরীয় সমাজ ব্যবস্থার ধনী-দরিদ্রের চরম অমানবিক বৈষম্য দেখানো হয়েছে ছবিতে। একটি ধনী পরিবার যারা ঝলমলে ফ্ল্যাটে অত্যন্ত উন্নত জীবন যাপন করে এবং আরেকটি দরিদ্র পরিবার যারা একটি ভবনের বেজমেন্টে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এই দুই পরিবারের মধ্যকার বৈষম্যমূলক সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প নিয়ে ‘প্যারাসাইট।’ দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ শ্রমজীবী শ্রেণিদের দুঃখ-কষ্ট ফুটে উঠেছে ছবিতে।
অ্যাটলান্টিকস (২০১৯): সেনেগালের এই অসাধারণ ছবিটি পরিচালনা করেছেন মাটি ডিওপ। অতিপ্রাকৃতিক নানা ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে জাত, ভালোবাসা এবং অভিবাসনের গল্প। আদা নামের একটি মেয়ে ভালোবাসে অ্যাটলান্টিক সাগরের পাড়ের একটু সুউচ্চ ভবনের নির্মাণ শ্রমিক সুলেইমানকে। কয়েকমাস ধরে বেতন পায়না সুলেইমান ও অন্য শ্রমিকরা। ভালো কাজের সন্ধানে তারা ছোট একটি নৌকায় সাগর পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তাদের মৃত্যু হয়। কিন্তু তাদের আত্মারা ফিরে আসে।
স্যরি টু বদার ইউ (২০১৮): বুটস রাইলির পরিচালনায় অভিষেক হয় এই ছবির মাধ্যমে। হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় কঠিন বাস্তবতাকে। লাকেইথ স্ট্যানফিল্ড অভিনীত এই ছবির মূল চরিত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গের তরুণ। সাদাদের উচ্চারণ শিখে টেলিমার্কেটিং চাকরিতে বেশ ভালো করেছে সে। পদন্নোতিও হয়। কিন্তু এরপর তার কাছে নিজেকে একা মনে হতে থাকে। প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া আর্থিক সুযোগ-সুবিধার কারণে অধীনস্থ কর্মীদের অধিকার আদায় প্রসঙ্গে মুখ খোলা নিয়ে দোটানায় ভুগতে থাকে সে।
টাইগারটেইল (২০২০): অ্যালান ইয়াং পরিচালিত প্রথম ছবি এটি। তাইওয়ানের একটি ফ্যাক্টরিতে মা ও ছেলে কাজ করেন। একদিন কাজ করতে গিয়ে মা গুরুতর আহত হন। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রেমিকাকে ছেড়ে এক ধনী ব্যক্তির মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাকে কাজ করতে হয় দোকানের কর্মচারী হিসেবে। এমন গরীব অভিবাসী জীবনের স্বপ্ন তো সে দেখেনি!
রোমা (২০১৮): মেক্সিকান নির্মাতা আলফনসো কুয়ারনের সাদাকালো ছবি ‘রোমা’। সত্তর দশকের গোঁড়ার দিককার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একবছরের গল্প তুলে ধরা হয়েছে এতে। ছবির মূল চরিত্র ক্লিও। এক অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুকে দেখাশোনা সহ ঘর পরিষ্কারের কাজ করেন ক্লিও। ক্লিও গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর ছবি মোড় নেই ভিন্ন দিকে। আলফনসো কুয়ারন মেক্সিকোর ক্লাস এবং ইথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে সম্পর্কটাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ছবিতে।
দ্য মোটরসাইকেল ডায়রিজ (২০০৪): চে গেভারার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় নিয়ে এই সিনেমাটি করা হয়েছে। ১৯৫২ সালে আর্জেন্টিনার অধিবাসী চে বন্ধু আলবার্টো গ্রানাডোকে নিয়ে চে বের হয়ে পড়েন এক মোটরসাইকেল ট্রিপে। তখন ডাক্তারি পড়ার শেষ বর্ষ চলছিল তাদের। তিনি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ভেতরে ব্রাজিল থেকে পেরু পর্যন্ত এই দীর্ঘ ভ্রমণে তিনি প্রত্যক্ষ করেন দরিদ্রতা, শোষণ, বৈষম্য, অসহায় স্থানীয় মানুষদেরকে কিভাবে সম্পদ-লোভী শিল্পপতিরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করছে তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার থেকে। যাত্রা শেষ করে পেরুর লেপার কলোনিতে যখন চে পৌঁছলেন, তখন তিনি পরিণত হয়েছেন ভিন্ন এক মানুষে। নিজের নিরাপদ ভবিষ্যতকে পায়ে ঠেলে দিয়ে তিনি সর্বহারা মানুষদের পাশে দাঁড়ালেন আর জন্ম নিলো এক মহামানবের। তার সেই মোটরসাইকেল ভ্রমণের ডায়েরী প্রকাশ হয় বই আকারে। এই বই অবলম্বনেই ২০০৪ সালে গার্সিয়া বের্নালকে সিনেমাটি নির্মাণ করেন।
মেড ইন ডাগেনহাম (২০১০): ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ডের দাগেনহামে ফোর্ড দাগেনহাম প্ল্যান্টের প্রায় ২০০ নারী কর্মচারী সমান বেতনের জন্য ধর্মঘট শুরু করেন। যুক্তরাজ্যের প্রায় সব ফোর্ড অটোমোবাইল প্ল্যান্টের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা নিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে ছবিটি।
স্নোপিয়ার্সার (২০১৩): বং জুন-হোর আলোচিত চলচ্চিত্র ‘স্নোপিয়ার্সার’। পৃথিবীজুড়ে বরফযুগ শুরু হওয়ার সাত বছর পরের কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে ছবিটি। ছবিতে উঠে এসেছে শ্রেণীবিভাজনের নির্মম বাস্তবতা।প্রধান উপজীব্য পৃথিবীজুড়ে ঘুরতে থাকা ‘স্নোপিয়ার্সার’ ট্রেন। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষরাই এ ট্রেনের যাত্রী। বর্তমান সমাজব্যবস্থার মতোই ট্রেনটিতে বাসিন্দারাও নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। দরিদ্ররা ট্রেনের একদম পেছনের বগিতে। দরিদ্রদের উপেক্ষা করে এলিটদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টার চিত্র ফুটে উঠেছে ছবিতে।