সংসারের অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সেই অভাব ঘোচাতে চলে আসেন রাজধানী ঢাকা। কাজ নেন সিকিউরিটি গার্ডের। গত কয়েক বছর ধরে সেই কাজই করে যাচ্ছেন মোশারফ হোসেন। আর তার স্ত্রী মাহফুজা খাতুনও বসে থাকেননি। বাসায় বাসায় কাজ করেছেন ছেলেকে মানুষ করতে। অভাব তাদের সেই সংকল্পে বাধা হতে পারেনি।
মোশারফ-মাহফুজা দম্পতির বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামে। তাদের স্বল্প আয়ে ছেলে গোলাম রসুল সুইট আজ সহকারী জজ। শুধু তাই নয়, ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে হয়েছেন ৬৭তম। মঙ্গলবার যোগ দেবেন পিরোজপুর জেলায় সহকারী জজ হিসেবে।
পাহাড় সমান সব বাধা পেরিয়ে গোলাম রসুল আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। নিজের সাফল্য আর সংগ্রামের গল্প বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে।
গর্বিত পরিবার আর নিজেকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘কলেজ শেষ করার পর লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেসময় সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমির একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করার পর সেখান থেকে শিল্পকলা একাডেমির এক ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে মায়ের একটি গরু ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে ২০১০ সালের ১৭ মে ঢাকায় এসে একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই।’
‘‘কিছু দিনের মধ্যে গরু বিক্রির টাকা ফুরিয়ে গেলে পরে কোচিং পরিচালকের দয়ায় সেখানে বিনামূল্যে থাকা ও কোচিংয়ের সুযোগ পাই।’’
সেইসব বন্ধুদের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে সুইট বলেন, সহপাঠী বন্ধুরা আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতো। তাদের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই এতদূর আসা সম্ভব ছিল না।
জীবন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ সহকারি জজ বলেন, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতো আমাদের। দেবহাটার শাখরা কোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি স্থানীয় দাখিল মাদরাসায় হন। সেখান থেকে এসএসসি সমমানের পরীক্ষায় ২০০৭ সালে জিপিএ ৫ পেয়ে ভর্তি হন সখিপুর খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ্ কলেজে। ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৪.১০ পেয়ে উর্ত্তীণ হন। এরপরই অভাবের কারণে তার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
এরপর ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার গল্প শুনানোর এক পর্যায়ে সুইট চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ হয়। বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হই। ভর্তির পর নিজে হাতে পোস্টার ছাপিয়ে অভিভাবকদের কাছে বিতরণ শুরু করি। এভাবে পাঁচটি টিউশনি জোগাড় হয়ে যায়। এভাবেই চলেছে আমার শিক্ষাজীবন। আত্মীয়-স্বজনরা কখনো খোঁজ নেয়নি তবে আমার বন্ধুরা আমার পাশে থেকেছে সব সময়।’
‘‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ফলাফলে ‘বি’ ইউনিটে মেধা তালিকায় হয়েছি ১১তম। ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে হয়েছি ৬৭তম। আমার বড়লোক হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। সব সময় ন্যায়ের পথে থেকে মানুষদের জন্য কাজ করে যাবো। কখনোই অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করব না। যখন চাকরি জীবন শেষ করবো তখন যেন অবৈধ উপায়ে উপার্জনের একটি টাকাও আমার ব্যাংক একাউন্টে না থাকে। আমার কাছে সকল মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। অসহায় মানুষরা কখনোই ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।’’
গরীব ও অভাবী মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে গোলাম রসুল সুইট বলেন, ‘টাকা পয়সা লেখাপড়ার পথে কোনো বাধা নয়। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সে এগিয়ে যাবেই, পথ বেরিয়ে যাবেই। দুস্থ পরিবারের সমস্যাগুলো আমি বুঝি, নিজে দেখেছি।’
সুইটের বাবা মোশারফ হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে আট বছর সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছি। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই থাকতাম। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। এক মাস আগে ছেলে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছে। তাই চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছি। ছেলে বলেছে, আমি এখন চাকুরি পেয়েছি আপনার কাজ করতে হবে না। ভাবছি এলাকায় ছোট একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করবো।
অন্যের বাড়িতে কাজের বুয়া থাকাকালীন সময়ের কথা মনে করে কেঁদে উঠেন মা মাহফুজা খাতুন। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। স্বামী আর আমার টাকা দিয়েই চলতো সংসার আর দুই ছেলের খরচ। আমরা যেটুকু পেরেছি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ছেলের লেখাপড়া করানোর জন্য। দোয়া করেছি আল্লাহর কাছে। আল্লাহ আমাদের ডাক শুনেছেন। দোয়া কবুল করেছেন। আমি অনেক খুশি। এখন সকল মানুষের কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।’
সুইটের প্রতিবেশী কওসার আলী গাজী বলেন, ‘এগারো শতক জমির উপর ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই তাদের। অভাবের সংসার। রসুলের বাবা ঢাকায় দারোয়ানের কাজ এবং মা বুয়ার কাজ করতেন। এভাবেই চলেছে এতদিন তাদের সংসার। নতুন করে দুই চালা একটা ঘর করেছে। সম্পদ বলতে শুধু এটুকুই তাদের। রসুল এখন জজ হয়েছে প্রতিবেশীসহ এলাকার মানুষ খুশি।’
গোলাম রসুল সুইটের বাল্যবন্ধু জাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শান্ত ও মেধাবী ছিল রসুল। আমরা এক সঙ্গেই লেখাপড়া করতাম। কখনো কারো সঙ্গে জোর গলায় কথা বলেছে, আমাদের জানা নেই।’
দেবহাটার পারুলিয়ার ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, ‘খুব অভাবী পরিবার। মা-বাবা খুব কষ্ট করে ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। ছেলেটাও খুব ভালো। জজের চাকুরি পেয়েছে। এতে এলাকার সকল মানুষ খুশি হয়েছে।’
সুইটের সফলতার বিষয়ে জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘শুধু অর্থই মানুষকে অনেক কিছু দিতে পারে না। পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই। পরিশ্রম করে আজ সহকারী জজ হয়েছেন গোলাম রসুল সুইট। জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি তার এ সফলতায় তার মা ও বাবার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও আন্তরিক অভিনন্দন’।