‘‘এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় পড়ে আছে এক দৈত্যাকার পোকায় রূপান্তরিত হয়ে।’’ (মেটামরফোসিস, ফ্রানৎস কাফকা)
লিখতে বসেছি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিকতম কথামালা। তাতে মহাশক্তিমান শব্দশিল্পী ফ্রানৎস কাফকা-কে কেনো টেনে আনা সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, আপাতত টাইগার ক্রিকেটের সাম্প্রতিক নিয়ে বলার ইচ্ছা-ফলাতেই ‘শান’ দিতে থাকি!
শান, শানশওকত, গৌরব, প্রতাপ… এইসবই তো, নাকি? বাংলাদেশ ক্রিকেটের শানশওকত এখন কেমন চোখে আটকাচ্ছে? চোখ ছানাবড়া হচ্ছে, ঘনঘন কচলাতে হচ্ছে, লাল টসটসে হয়ে উঠছে প্রায়শই? ও পোড়া চোখ সমুদ্রে চল গাইতে হচ্ছে?
টাইগার ক্রিকেটের সাম্প্রতিকতম নিয়ে শতকরা ৯৮ জনের উত্তরই যে সুখকর কোনো শব্দে ধেয়ে আসবে না, সে প্রসঙ্গে ক্রিকেটশুমারি না চালিয়েও বেশ বলে দেয়া যাচ্ছে। বাকি যে দুই ভাগকে রাখতে হচ্ছে তারা হয় ক্রিকেটটা ঘাঁটেন না, সেভাবে উপভোগ করেন না, নয় নিতান্তই হেঁয়ালি উত্তর দেন সবকিছুতে!
তাদের কথা থাক! বাকিদের কাছে ক্রিকেটের যে স্থান, আবেগ-মেজাজের উত্তাপ মাপার যে একক হয়ে উঠেছে খেলাটি, তাতে দগদগে ক্ষতই চোখে পড়ছে আজকাল। না, বাংলাদেশ দল আধুনিক ক্রিকেটের মানদণ্ডে এমন কোনো পর্যায়ে এখনও অধিষ্ঠিত হয়নি যাতে দিব্যি লিখে দেয়া যায় ‘সর্বজয়ীর দুর্দশা’ চলছে। অনেকখানি পাঠপথ পেরিয়ে এসেও লাল-সবুজের ক্রিকেট যেন এখনও শিশুই! সমস্যা হল, সেই শিশুর কিশোরবেলা পেরিয়ে যৌবনে পা রাখার কোনো তাড়নাই নেই। যেখানে টগবগিয়ে বিশ্বজয় করবেন দামালরা। বলবেন, তোমার ভয় নেই মা আমরা ব্যাট-বল করতে জানি!
জগতজুড়ে ভয়ের সংস্কৃতির চাষ, সেটাই যেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনেও ঢুকে গেছে। কদিন আগে জিম্বাবুয়ের মাটিতে টাইগাররা যেভাবে নাস্তানাবুদ হল, ভয় না পেয়ে বিকল্পও খুব বেশি নেই। হারারের স্মৃতি অশনিসংকেতের মতো জানান দিয়ে গেছে অনেককিছুই। ক্রীড়া রসিকদের ভাষায়, এখন জিম্বাবুয়েও আর নিরাপদ প্রতিপক্ষ নয়!
টি-টুয়েন্টিতে আমাদের হয় না! অবশ্য সামর্থ্যের ঘাটতিই বলা নিরাপদ! বিগ হিটার সংকট। বিগ হিট না হয় মিলছে না, ছোট ফরম্যাটে মাঠে দেখা যায় ছোট হিটও মিলছে না। যিনি ধুপধাপ কয়েকটা চার হাঁকাচ্ছেন, তিনি সিঙ্গেল বের করতে পারছেন না, স্ট্রাইকরেট দিন শেষে টি-টুয়েন্টির মতো থাকছে না তার। যিনি সিঙ্গেলস-ডাবলস বের করছেন, দেখা যাচ্ছে তিনি আবার বাউন্ডারির ফাঁকফোকর বের করতে পারছেন না। যাকে নামানো হচ্ছে পাওয়ার প্লেতে, তিনি যেন ফরম্যাটই ভুলে যাচ্ছেন। যিনি আসছেন ফিনিশিংয়ে, হয়ত ম্যাচটাই ‘ফিনিশ’ করে দিয়ে যাচ্ছেন টুকটুক করে। যেদিন ব্যাটে তাও কিছু আসছে, সেদিন বোলাররা ঘুমন্ত, বোলার জাগলে ফিল্ডারের হাত হচ্ছে পিচ্ছিল। কোনকিছুর সাথে অন্যকিছুর মিলনমালা যেন দূরহ কোনো কাজ হয়ে পড়েছে।
সেটা আরও দূরহ হয়ে ওঠে টেস্ট ক্রিকেটের ময়দানে গেলে। ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের অনেক ঝলকের দেখাই সেখানে মেলে, দলীয় ঝলক যেন সোনার হরিণ। বোলারদের মুখরক্ষার তাও কিছু থাকে, কারণ ভালো বোলিংয়ের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের ভুল করার একটা ব্যাপারও যে এখানে নিহিত। কিন্তু নিজেদের ব্যাটারদের তাড়াহুড়ায় সাদা পোশাকেও দিনশেষে সেই একঘেয়ে বিবর্ণ চিত্রনাট্যই।
যা একটু বুক ফুলিয়ে বলার মতো, সেটা ওই ওয়ানডেতে। জিম্বাবুয়ে সিরিজে তাতেও লেগে গেছে লাল কালির ধাক্কা। সেই ধাক্কা বিশ্লেষণের আগেই দুয়ারে এশিয়া কাপের কড়া নাড়া। তারপর বিশ্বকাপের আগমনী। মাঝে নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ। সবগুলোই টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটে। হারারে বিপর্যয়ের পর নিজেদের কাটাছেঁড়ার যে কটাদিন পাওয়া যেত, বিসিবি থেকে টিম ম্যানেজমেন্ট হয়ে সংবাদমাধ্যম, সেকটা দিন সব পক্ষকেই বরাদ্দ রাখতে হল সাকিব আল হাসানের নয়া কেচ্ছার জন্য।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্য ধাতুর এই ক্রিকেটারটির সৌজন্যে তেমন কেচ্ছার বরাদ্দ অবশ্য নিত্য হয়ে উঠেছে। একটা করে সিরিজ-টুর্নামেন্ট উঁকি দেয়, সবটুকু মনোযোগ দিয়ে দিতে হয় সাকিবের দিকে। তিনি খেললেও, না খেললেও অন্যদিকে মনোযোগ ঘোরানোর সুযোগ দেন না কাউকেই! এটা যেন অমোঘ এক নিয়তি বানিয়ে ফেলেছেন শেষ ক-বছরে। দলের আত্ম-পর্যালোচনার এই সময়টাতে সাকিব সবকিছু তার পর্যালোচনায় এমনভাবে জড়িয়ে নেন, দল-স্কোয়াড-কোচ-ম্যানেজমেন্ট-বোর্ড, সবকিছু ঢাকা পড়ে যায় বিশাল এক ছায়াতলে।
সাকিব অনেক বড় তারকা, শুধু দেশের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই নয়, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেরই বড় তারকা। তার আলোয় রোশনাই হবে দিগন্ত, ছায়ায় আড়াল হবে বিস্তীর্ণাঞ্চল, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাকিব যেন পণ করেছেন মাঝেমধ্যেই তার আঁধারেও নিমজ্জিত করবেন চারপাশ! বেটিং-সাইট কেলেঙ্কারির সবশেষ ঘটনায় সেটা আরও একবার হুলস্থূল করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
সাকিবের যুক্তি তিনি সরাসরি বেটিং সাইটের সাথে চুক্তি করেননি, তাদের নিউজ সাইটের সাথে চুক্তি করেছেন। বিসিবির কথা ছিল এমন কোনকিছুর সাথে জড়ানো যাবে না যাদের শেকড় ওই বেটিংয়ে। সাকিব আবার বিসিবিকে পাত্তা না দিয়ে কাজটা করেছেন। জানালে করতে পারতেন না সেটা অবশ্য তার অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি বেতনভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির ধার কবারই বা ধরেছেন এসব ক্ষেত্রে। বিসিবির হুঙ্কারের শেষে অবশ্য দফারফা হয়েছে। দুপক্ষের টানাটানির শেষে সাকিব চুক্তি থেকে সরে এসেছেন, মিষ্টি হেসে চুমু উড়িয়ে বলেছেন ‘আমার ভুল হয়ে গেছে’। সেসবের আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্রচার ছিল তুঙ্গে, তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট ভালোরকমেই ব্যবহৃত হয়ে গেছে বেটিং ইস্যুতে। শেষে কে জিতেছে কে হেরেছে নিরূপণও মুশকিল হয়ে গেছে তাই!
আশার কথা সবকিছুর শেষ আছের মতো এই ঘটনা এখন অতীত না হয়েও আড়াল। এসব ডামাডোলের মাঝেই এশিয়া কাপের দল ঘোষণা হয়ে গেছে। অধিনায়কত্ব হারানো, দলে জায়গা নিয়ে তুমুল প্রশ্নের মুখে থাকা দীর্ঘদিনের সারথি ‘অনেকদিনের অপ্রকাশিত অভিজ্ঞতা’ সঙ্গী করে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ টি-টুয়েন্টিতে টিকে গেছেন। যার আসলে গত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের পর দেশের বিমানে ওঠার আগেই মারকুটে ফরম্যাটের ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলার কথা ছিল।
এদিকে যদি লেগে যায় থিওরিতে বছর তিনেক পর ফিরেছেন সাব্বির রহমান। আধা ডজন ওপেনার নিয়ে জিম্বাবুয়ে ঘুরে আসা দল এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে যাচ্ছে দুজন ওপেনার নিয়ে। অনাহূত চোটে পড়া লিটন দাশের বিকল্প তো আমাদের নেই-ই; মালা বিচ্ছিন্ন ফুল, প্রায় ভুলোমন স্মৃতির সৌম্য সরকারের বিকল্পও যে আমাদের নেই সেটাও চেপে রাখা যায়নি এই দল ঘোষণায়। গত কয়েক সিরিজে টি-টুয়েন্টি দলের সাথে পর্যটক বেশে ঘুরতে থাকা মেহেদী মিরাজও যাচ্ছেন আরব আমিরাতে, নয়নজুড়িয়ে অনেকগুলো টি-টুয়েন্টি দেখার আড়ষ্টতা ঝেরে তিনি হয়ত মাঠেও নামবেন। পেস-অলরাউন্ডার নামের ‘সোনার হরিণ’ সাইফউদ্দিন ফিরেছেন। ইতিবাচকের ওড়া পালে হাসান-ইবাদতের সংযুক্তি ঘটেছে। সবচেয়ে ইতিবাচক হল, এই দলটির অধিনায়ক করা হয়েছে সাকিব আল হাসানকে।
সাকিব এখন সব ক্রিকেট খেলতে চান না। সব সিরিজেও নয়। দলকে টেনে তোলার জন্য এখনও সেই সাকিবই আমাদের অদ্বিতীয় ভরসা। সেটা মন্দও নয়। সাকিবকে দিয়ে অনেককিছুই হয়েছে। হারারেতে ফাঁকফোকর বেরিয়ে পড়া টাইগার ক্রিকেটের পুনর্গঠনে যদি তাকে নেতৃত্বে ফিরিয়ে পথে ফেরা যায়, মন্দ কী! অবশ্য অন্য দেশগুলো যেখানে কয়েকজন মোস্ট সিনিয়র পথপ্রদর্শক হয়ে দলে থাকতেই তরুণ অধিনায়ককে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়, আজও সেই সংস্কৃতিতে বিসিবির ঢুকতে না পারার প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
কে ঢুকছে, কে ছিটকে যাচ্ছে, কে কবে অধিনায়ক হয়ে যাচ্ছে; দল যখন এমন ছন্নছাড়া, ছন্নছাড়া পরিকল্পনা, তার চেয়েও বেশি ছন্নছাড়া বোর্ড, সেসবের শেষ টানতে পারলে সাকিবই পারবেন, এমন ভাবনাই যখন স্থিরবিন্দু হয়ে এসেছে, তাতে সাকিবের জন্য শুভ কামনা না জানিয়ে থাকাটাও আবার অন্যায্য। সাকিব এই ন্যায্যতার পাল্লাটা নিজের দিকে অর্জন করে নিয়েছেন, তেমনি অর্জন করেছেন অসংখ্য বিতর্কও। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় ভুলতে চাওয়া সেসব বিতর্ক বিসর্জনের পাল্লায় ছুঁড়ে তিনি অর্জনের মানদণ্ড আরও শিখরে উঁচিয়ে ত্রাতা হবেন, হলে সেটাই হোক। সবসময়ই ভিন্নরকম আত্মবিশ্বাসী সাকিবের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভবও। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও বৃহস্পতিবার বললেন সে কথা, এই মুহূর্তে সাকিবের আত্মবিশ্বাসটা থাকা জরুরি, যেটা সবসময়ই তার থাকে।
শেষ করার আগে আসি লেখার শুরুতে ফ্রানৎস কাফকার সেই মেটামরফোসিস তথা রূপান্তর প্রসঙ্গে। একটা দল টেস্টে পারছে না, টি-টুয়েন্টিতে পারছে না। শুধু পারছে না বললে কমই বলা হবে, কখনও কখনও একেবারে ধরাশায়ী হচ্ছে। সেই দলটাই কিনা নাস্তানাবুদ হওয়া পারফরম্যান্সের পর নির্ভেজাল একটা ঘুম দিয়ে ভিন্ন সকালে একেবারে কাফকার গল্পের মতো রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। বিশালাকায় দৈত্য (আক্ষরিক অর্থে নয়) হয়ে বধ করছে তাবৎ ওয়ানডে প্রতিপক্ষকে। সুপার লিগ টেবিলে থাকছে জায়ান্ট সব দলের ঘাড়ের উপর। কী আশ্চর্য তাই না! সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সেই রূপান্তরটাই হোক টেস্ট ও টি-টুয়েন্টিতে, এখন তো এ দুই ফরম্যাটেরই অধিনায়ক তিনি। আপাতত রূপান্তরটা টি-টুয়েন্টিতে হলেই চলে। কদিনের বিশ্রাম কাটিয়ে শিগগিরই সাকিবের দল যে এশিয়া কাপের প্রস্তুতিতে নেমে পড়বে সবশেষ ১৪ টি-টুয়েন্টিতে কেবল দুটি জয়ের স্মৃতি নিয়ে।
ঘুরে দাঁড়াতে পারলে কেটে যাবে সাম্প্রতিকতম বিষাদের সুর। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবকিছুই আবার সুখী সুখী দেখাবে। উল্টোটা হলে ক্রমেই তলানি ছোঁয়া। তখন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতার সেই বিখ্যাত লাইন কটা ঘুরিয়ে বলার মতো পরিস্থিতি হতে পারে, যা এখন বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য বেশ বলা যায়, ‘বহু বছর পর, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বহুদিন আগের সেই বিকেলটার কথা মনে পড়ে গেল, যেদিন তার বাবা তাকে ফুটবল দেখাবার জন্য নিয়ে গিয়েছিল!’ যেন কখনোই বলতে না হয় ‘‘ক্রিকেট দেখাবার জন্য নিয়ে গিয়েছিল…!’’
বিজ্ঞাপন