আমার এক পরম অগ্রজ আছেন। সম্পর্ক কবে থেকে? তার কোনো সীমারেখা নেই। হয়তো ১৯৮০ সাল। হায়রে এর মধ্যে কেটে গেছে ৪০ বছর। কোন সাইফুল আলমের পরিচয় তুলে ধরব? কিশোর বাংলার সাহিত্য সম্পাদক চাঁদের হাটের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাকি পরবর্তীকালের বিখ্যাত সাংবাদিক? বর্তমানে জনপ্রিয় ও বস্তুনিষ্ঠ ‘যুগান্তর’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক? আরও অনেক কথা বলা যায়।
সাইফুল আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। তাকে সবাই ভালোবেসে ‘লিটন’ বলে ডাকে। আমরা বলি, লিটন ভাই। তারা এক বিশাল বন্ধুপ্রেমী। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে চাঁদের হাট সংগঠনের সাথে জড়িত। দৈনিক পূর্বদেশে প্রতি সপ্তাহে দুই পাতা শিশুকিশোর উপযোগী চাঁদের হাট প্রকাশিত হতো। তৎকালীন প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা এই পাতাকে কেন্দ্র করে লেখালেখি করতেন। সেই দলে ছিলেন ইমদাদুল হক মিলন, আফজাল হোসেন, মাহমুদ দিদার, শাহ আলমগীর, লিজি রহমান, ফরিদুর রেজা সাগর, কিউরি খন্দকার, আবদুর রহমান, এনায়েত রসুল, রোকেয়া খাতুন রুবী, শাহেরা খাতুন বেলা, মোবাশ্বেরা খানম, মাহমুদা চৌধুরী, মুনা মালতী, শুমু আপা এরকম অনেক নাম। এই মিছিলের একজন উজ্জ্বল পথিক সাইফুল আলম।
পরে শিশু কিশোর সাপ্তাহিক হিসাবে ‘কিশোর বাংলা’ নামে অসাধারণ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বাংলা পত্রিকার জগতে নতুন ইতিহাস। প্রথমে কিশোর বাংলা প্রকাশিত হয় দৈনিক বাংলা ভবন থেকে। সম্পাদক ছিলেন সানাউল্লাহ নূরী। প্রথম সংখ্যায় ট্যাবলয়েড সাইজ। একটা বাচ্চা ছেলে ট্রাফিক সেজে রাস্তার মোড়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। মূল ফিচার সানাউল্লাহ নূরী স্বয়ং লিখেছেন, বিশ্বের প্রথম থিয়েটার।
কিছুদিন চলার পর পত্রিকাটা অবজারভার ভবনে চলে যায় প্রধান সম্পাদক থাকেন সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ। বিনোদন সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। চিত্রালী সম্পাদক। একসময় নাকি চিত্রালী লক্ষাধিক কপি বিক্রি হতো।
অবজারভার ভবনের দোতলায় কিশোর বাংলার কার্যালয়। সম্পাদক বিখ্যাত রফিকুল হক দাদু ভাই। বাংলা ছড়ার কিংবদন্তী ব্যক্তি। দাদুভাই ঘিরে কিশোর বাংলার কর্মী বাহিনী। সাইফুল আলম, শাহ আলমগীর, মুস্তাফা মজিদ, আবদুর রহমান প্রমুখের কথা মনে পড়ে। আর পত্রিকাটির মেকাপ গেট আপ ও অঙ্গষ্যেষ্ঠবের দায়িত্বে ছিলেন অভিনেতা আফজাল হোসেন। সে এক জমজমাট সময়কাল আমাদের কৈশর আর সাইফুলদের যৌবন।
সাইফুল তখন আমার অনেক লেখা ছেপেছেন কিশোর বাংলায়। গল্প ছড়া ফিচার। নানা ধরনের লেখা। ভালো লেখা হলেই সাইফুল ভাই ছাপতেন। উৎসাহ দিতেন। আমরা তরুণ বলে কখনো অবহেলা করেননি।
একসময় কিশোর বাংলা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি বরাদ্দ কমে আসে। সাইফুল ভাই তারপর পুরোপুরি পেশাদারি সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। তবে চাঁদের হাট সংগঠনের সঙ্গে তার যোগাযোগ বরাবরই ছিল।
আমরাও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, কিশোর তরুণদের উৎকর্ষধর্মী মাসিক ‘আসন্ন’ পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এসব নিয়ে খুব ব্যস্ত। সাইফুল ভাই যুগান্তর প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিরিয়াসভাবে সংযুক্ত রইলেন। যুগান্তরের অফিস তখন মতিঝিলের উল্টো দিকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। আমরা মাঝে মাঝে যাই।
একদিনের কথা। ১৯৯৭ সাল। বইমেলা চলছে। আমার সেই বছর ‘এক হাজার ছড়া’ নামে একটি ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অনন্যা থেকে। ধ্রুবর অসাধারণ প্রচ্ছদ। বইমেলায় বইটি আলোচিত হয়। মনে আছে সাইফুল ভাই যুগান্তরের রিপোর্টারকে আলাদা রিপোর্ট করতে বললেন। আমাকে বললেন, তোর বইটার কথা খুব শুনলাম। বইটা পড়বো। পাঠা আমাকে।
খুব আন্তরিকভাবে ‘তুই’ সম্বোধন করে থাকেন সাইফুল ভাই। তার এই আদর মাখা সম্ভাষণ সারাজীবন আমাদের প্রেরণা দিয়েছে। আমরা কি লিখছি কি করছি কি পড়ছি। সব খবরই তিনি রাখেন। শত ব্যস্ততাতেও ‘কিরে কি খবর’ এই আন্তরিকতা তিনি দেখিয়ে থাকেন।
আমাদের বই সংগ্রহ করে পড়েন। ভালোমন্দ মন্তব্য করেন।
চ্যানেল আইতে যেদিন থেকে জড়িত আছি সেদিন থেকে সাইফুল আলম আমাদের সাথে। ‘সংবাদপত্রে বাংলাদেশ’ বছরের পর বছর তিনি উপস্থাপনা করে যাচ্ছেন। সাইফুল ভাই এই ধরনের অনুষ্ঠান যে ভালো উপস্থাপনা করবেন আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল। সাগর ভাইকে বলতেই সাগর ভাই এক বাক্যে রাজি। সাইফুল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে সব ফাইনাল হলো। সাগর ভাই, সাইফুল ভাই পরস্পর প্রিয় বন্ধু। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের অধিককাল এই বন্ধুত্ব। সংবাদপত্রে বাংরাদেশ অনুষ্ঠানের সূত্রে সাইফুল ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়।
কিরে তোর খবর কি? কই থাকস? তোরে দেখিনা?
এই হচ্ছেন সাইফুল আলম। অত্যন্ত নেতাসুলভ আচরণ। সাধ্যে যতটুকু কুলায় মানুষের জন্য সেটা করে থাকেন। বর্তমানে তিনি সাংবাদিকদের মধ্যে একজন বিশাল নেতা। জাতীয় প্রেসক্লাবের তিনি সভাপতি। কিন্তু সেই রাসগম্ভীর সম্পাদকসুলভ মূর্তি তার দেখিনি।
এই তো সেদিন।
জাতীয় প্রেসক্লাবে সন্ধ্যায় চাঁদের হাটের প্রাক্তনীদের এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। আয়োজক সাইফুল ভাই। প্রাক্তন সদস্যদের উপস্থিতিতে আলোকিত হয়েছে ভিআইপি লাউঞ্জ। কত বিখ্যাত মানুষ সেদিন শিশুর মতো স্মৃতিকথা বলা শুরু করলেন। চারধারে সোফা সেট। এক ধারে বসে আলো ছড়াচ্ছেন রফিকুল হক দাদুভাই। আমাদের গুরু। সাইফুল ভাই বর্তমানে যুগান্তর সম্পাদক এবং সাংবাদিক নেতা কিন্তু তিনি গুরুকে ভুলে যাননি। যুগান্তরে দাদুভাই চাকরি করেন। তার প্রতি দায়িত্ব সাইফুল ভাই পালন করেন। অনেক স্মৃতিকথা, অনেক ভূরিভোজের পর সেদিন বিদায় নিই। আমাকে ফোনে বলেছিলেন আইসা পড়িস সন্ধ্যায়। আড্ডা হবে।
খাওয়ার টেবিলে এসে বললেন, কিরে এতো কম খাবার নিলি কেন? ও হো তোর তো ডায়াবেটিস আছে। তারপরও ঢাকার বাইরে থেকে আনা মিষ্টি এক টুকরো খাবি।
সাইফুল ভাইয়ের সুখী জীবন। আন্দোলন, রাজনীতি সারাজীবন করেছেন। ভাবী একজন খ্যাতনামা ব্যাংকার। ছেলেমেরা প্রতিষ্ঠিত।
সাইফুল ভাই ভালো থাকবেন। এই শহরে কে স্বার্থহীনভাবে আদর দিয়ে বলবে, আসিস তোর কাজটা করে দেব।
পুনশ্চ। একটা কথা বলে বিদায় নেব। তিনি একজন শক্তিমান লেখক। ‘ছেড়াপাতা’ নামে একটা কিশোর গল্পগ্রন্থ আমাদের শৈশব আচ্ছন্ন করেছিল। আবেগময় ছোট ছোট অনুভূতি নিয়ে গল্প। গল্পগুলো ছাপা হয়েছিল ‘কিশোর বাংলায়’। সাইফুল আলম কোন অভিমানে যে ছোটদের জন্য আর লেখেননি আমরা তা জানি না।
ইদানীং সাংবাদিকতা বিষয় ও কলাম নিয়ে তার বই বেরুচ্ছে। কিন্তু আমরা চাই তিনি আবারও কিশোরদের জন্য গল্প লিখবেন।