লোহিত সাগরের নীল ফেনিল জলরাশি আর সৈকতের শুভ্র বালু সৌদি আরবের ইয়ানবু শহরকে এক অনন্য মাত্রায় সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র রওজা মোবারক মদিনা থেকে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইয়ানবুতে তেল শোধনাগার ও তেল রপ্তানির পোর্ট, শিল্পকারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান শহরটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুনে।
ইয়ানবুর ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে একে রয়েল কমিশনের আওতায় এনে শিল্প কারখানার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করাসহ শহরকে আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়। ইয়ানবুর ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরনো। এক সময় ইয়ানবুর বন্দর দিয়ে মসলা, সুগন্ধিসহ বিভিন্ন পণ্য মিশর থেকে ইয়েমেন ও অন্যান্য দেশে পৌঁছে যেত। ইয়ানবুর বন্দর এ অঞ্চলে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনীর অফিসার থমাস এড ওয়ার লরেন্স, যিনি “লরেন্স অফ আরাবিয়া” নামে পরিচিত তিনি ১৯১৫-১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে তাঁর বাহিনী নিয়ে ইয়ানবুতে অবস্থান করেন। লরেন্স এখানে থেকে অটোমানদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতেন এবং বন্দর এলাকা থেকে এ অঞ্চলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন যার ফলে সহজেই বিজয় অর্জন করেন।
লরেন্স ও তাঁর বাহিনী ইয়ানবুতে যে বাড়িগুলোতে বসবাস করতেন তা দীর্ঘদিন পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল। সম্প্রতি ইয়ানবু শহরের মেয়র আহমেদ আল মাহতুত সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে পর্যটন বৃদ্ধির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসকল পরিত্যাক্ত ভবন সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন। যেকারণে সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন শতশত ভ্রমণপিয়াসু নাগরিকরা ছুটে আসছেন জাদুঘরে।

গত শতাব্দীর অভিজাত দ্বিতল বাড়িগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ দর্শনীয় এ স্থানটি সুরক্ষিত করার জন্য পুরনো দালানগুলো পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দীর্ঘ-পরিত্যক্ত এই বাড়িগুলোতে ভূতের বসবাস বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করতেন। কিন্তু মেয়র এই গুজবকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন এটি একবারেই সত্যি নয়। ভূতের ভয়ে সৌদি নাগরিকরা দীর্ঘদিন এই সকল বাড়ি থেকে দূরে থাকতেন। এই বাড়িগুলো ইয়ানবুর ঐতিহ্যের অংশ এবং পর্যটকরা খুব শীঘ্রই এই বাড়িগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন।
বাড়িগুলোর পাশেই রয়েছে একটি মসজিদ, যা অটোমান আমলে নির্মিত মক্কায় চকরিয়া প্রবাসী সৌদি আরব শাখার সম্মেলন অনুষ্ঠিত। সৌদি ব্যবসায়ী হিজ্জি আমাদের পুরো এলাকা ঘুরে দেখান এবং খুব সাবলীল ভাষায় লরেন্স অফ আরাবিয়ার ইতিহাস বর্ণনা করেন। তাঁর চমৎকার ইংরেজি উচ্চারণ আমাদের মুগ্ধ করে।
বাড়িগুলোর পাশেই রয়েছে একটি হেরিটেজ মার্কেট যা শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আরব রমণীরা মার্কেটটিতে ছোট ছোট দোকানে বিভিন্ন মনোরম শিল্পকর্ম, নারীদের ঐতিহ্যবাহী জামা, সুগন্ধিসহ নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। ছোট ছোট দোকানগুলোতে ঘুরতে যেয়ে মনে হবে যেন ফিরে গেছি প্রাচীন আরব সংস্কৃতিতে। মার্কেট এর দোকানগুলোর সামনে রয়েছে কাঠের ভাঁজ করা দরজা, যা উপরে নিচে দুভাগে ভাঁজ করে রাখা হয়। নিচের অংশ ভাঁজ করে একটি বেদির মত অংশে রাখা হয়, যেখানে বিভিন্ন জিনিস সাজিয়ে রাখা যায়। এছাড়া রয়েছে ঐতিহ্যবাহী কিছু মনোরম স্মারকের দোকান। যেখানে শতবর্ষ পুরনো বিভিন্ন দালানের স্মারক পাওয়া যায়।
ইয়ানবুতে রয়েছে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা ছোট একটি যাদুঘর। সৌদি নাগরিক সালেম আল জুহাইয়নি বলেন তিনি খুব ছোটবেলা থেকে যাদুঘরটি গড়ে তুলেছেন। যেখানে রয়েছে শত বর্ষের পুরনো বন্দুক, খবরের কাগজের কপি, বিভিন্ন মুদ্রা, সৌদিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র। এছাড়া রয়েছে বন্দর এলাকার নানা দর্শনীয় ঐতিহাসিক বস্তু। সালেম আমাদের সৌদি গাওয়া ও খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করেন। তিনি জানান তাঁর এ যাদুঘরে প্রায় ১০ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল এর সমপরিমাণ বিভিন্ন জিনিসপত্র রয়েছে।
সৌদি ব্যবসায়ী হিজ্জি জানান, এখানে অনেক বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মরত রয়েছে। যার প্রমাণ পেলাম স্থানীয় একটি নামকরা ফিশ ফ্রাইয়ের দোকানে যেয়ে। এখানে তাজা মাছ কেজি দরে কিনে ফ্রাই করে খেতে হয়। যার সবই লোহিত সাগরের মাছ। দোকানটিতে সকল কর্মচারীই বাংলাদেশী, শুধু ম্যানেজার হিসেবে রয়েছে একজন মিশরীয় নাগরিক। দোকানের বাইরে বাংলাদেশী অভিবাসী মোস্তফা তার বানানো স্পেশাল দুধ চা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করে।
সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) গত ২৫ অক্টোবর ইয়ানবুর রয়েল কমিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ফাহাদ দাইফাল্লাহ আল কোরেশীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে তিনি ও দূতাবাসের কর্মকর্তাগন ইয়ানবুর ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিদর্শন করেন। যা সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বন্ধন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে বলে রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেন। সৌদি ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে পর্যটন বৃদ্ধির জন্য সৌদি সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এসময় রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মসুলমানদের কাছে সৌদি আরবের পবিত্র শহর মক্কা, মদিনা ছাড়াও অন্যান্য শহরের অত্যন্ত গুরুত্ব উল্লেখ করে দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক পর্যটন বৃদ্ধির আহবান জানান। তিনি একই সাথে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ও সিলেটের চা বাগানসহ অন্যান্য স্থান সৌদি নাগরিকদের জন্য আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে উল্লেখ করেন।