রাজধানীতে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারানোর পর মারা যাওয়া রাজীবের ভাইদের ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে স্বজন পরিবহন।
বুধবার সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির আদালত স্বজন পরিবহনের আবেদনটি আগামী ১৩ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করেছেন।
আজ চেম্বার আদালতে হাইকোর্টের রায় স্থগিতের আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শফিকুল ইসলাম। আর রাজীবের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রাজীবের ভাইদের দুই মাসের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন তা স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন করে স্বজন পরিবহন। তবে আদালত কোন স্থগিতাদেশ না দিয়ে বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন। আশা করি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখবেন।

এর আগে গত ২০ জুন রাজীবের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানী শেষে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাজীবের দুই ভাইকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় দেন বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনকে দুই মাসের মধ্যে ২৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়।
এছাড়া এ রায়ে যাত্রী নিরাপত্তায় তিনটি নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। সেগুলো হচ্ছে:
১) রাস্তায় চলাচলের সময় গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। স্টপেজ ছাড়া গণপরিবহনের দরজা খোলা যাবে না।
২) চালকরা মাদক সেবন করে কিনা, তা জানতে নিয়মিতভাবে ডোপ টেস্ট করতে হবে।
৩) ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা ও সংরক্ষিত এলাকায় গাড়ির হর্ন বাজানো যাবে না।
এছাড়া হাইকোর্ট যাত্রী নিরাপত্তায় আরো যে চারটি নির্দেশনা ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলেন। সেগুলো হচ্ছে:
১) লাইসেন্স দেয়ার সময় চালকদের চোখের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা (ভিশন টেস্ট) ও ডোপ টেস্ট করাতে হবে।
২) বেপরোয়া গাড়ি চালায় কিনা তা নিয়ন্ত্রণ ও নির্ণয় করতে রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
৩) ঢাকা শহরে চলাচলকারী গণপরিবহনের রুট পারমিটের ক্ষেত্রে ‘ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেম’ চালু করতে হবে। যেখানে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলোকে একটি কোম্পানির অধীনে এনে প্রত্যেকটি রুটের গাড়িতে কালার কোড দিতে হবে।
৪) সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ আগামী ৬ মাসের মধ্যে কার্যকর করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এছাড়া রাজীবের দুর্ঘটনার বিষয়টির তদন্ত করে যে কমিটি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিয়েছে সে কমিটির সদস্যদের এক লাখ টাকা দিতে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয় হাইকোর্টের রায়ে। সেই সাথে আদালত বলেন: রাজীবের ক্ষতিপূরণ ও সড়কে যাত্রী নিরাপত্তার নির্দেশনার রায় দেওয়া হলেও এ বিষয়টি (কন্টিনিউয়াস ম্যান্ডামাস) চলমান বিচারিক বিবেচনায় থাকবে।
হাইকোর্টের রায় ঘোষণার সময় আদালতে রাজীবের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। বিআরটিসির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার মুনীরুজ্জামান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
এছাড়া রায় ঘোষণার সময় রাজিবের দুই ভাই মেহেদী হাসান ও আব্দুল্লাহ হৃদয় এবং রাজিবের খালা জাহানারা বেগম ও খাদিজা বেগম আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর রাজীবের ভাই মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন: আমাদের মতো যেন আর কাউকে ভাই হারাতে না হয়। হাইকোর্টের এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ। আশা করি হাইকোর্টের এ রায় গণপরিহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে।
এর আগে ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার সামনে দুই বাসের মাঝে পড়ে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল মারা যান তিনি।
দুর্ঘটনার দিন বাংলামোটর থেকে ফার্মগেটমুখী বিআরটিসির একটি দোতলা বাসে ছিলেন রাজীব। সেটি সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশে সিগন্যালে এসে থামে। এ সময় একই দিক থেকে আসা স্বজন পরিবহনের একটি বাস দ্রুতগতিতে দোতলা বাসের পাশের ফাঁক দিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে।
ওই সময় রাজীবের ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই বাসের মধ্যে ঝুলতে থাকে। রাজীবকে প্রথমে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ৪ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজীবের মৃত্যু হলে এই তথ্যসহ আদালতে একটি সম্পূরক আবেদন করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সেই আবেদনে রাজীবের ভাইদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আবেদন করা হয়।
এরপর হাইকোর্ট বিআরটিসি ও ‘স্বজন পরিবহন’কে ৫০ লাখ করে মোট ১ কোটি টাকা রাজীবের দুই ভাইকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন।
সেই সাথে সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইন সংশোধন বা নতুন করে বিধিমালা প্রণয়নের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।
এরপর বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
তবে রাজীবের দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে দায় নিরূপণ করতে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করতে হাইকোর্ট বেঞ্চকে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। আর ওই কমিটিকে হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এবং ওই প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চকে রাজীবের দুই ভাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে আদেশ দেন আপিল বেঞ্চ।
আপিল বিভাগের এ আদেশের পর বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে সিভিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান এবং নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেয়।
৪৯ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে এ দুর্ঘটনার জন্য স্বজন পরিবহনের চালকের বেপরোয়া চালনাকে দায়ী করে বলা হয়, ‘হালকা বাহন চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার পরও স্বজন পরিবহন ওই চালককে নিয়োগ করায় রাজীবের মৃত্যু ও দুর্ঘটনার মূল দায় মূলত স্বজন পরিবহনেরই।
এছাড়া হালকা বাহন চালানোর লাইসেন্স থাকার পরও চালককে বিআরটিসি ডাবল ডেকার বাস চালানোর অনুমোদন দেওয়ায় এই দুর্ঘটনার দায় বিআরটিসিরও। বিআরটিসির বিদ্যমান লিজভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থায় গণপরিবহনে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।’
এরপর হাইকোর্টে এই প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর এবিষয়ে জারি করা রুলের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। সেই রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে স্বজন পরিবহন।