একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল পুরস্কার, কবি আহসান হাবীব পুরস্কার, কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি রফিক আজাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ৭৫ বছর বয়সী এই কবির সুস্থতা নিয়ে সাহিত্য অঙ্গনের প্রতিটি মানুষ ছিল চিন্তিত। সকলের প্রার্থনা ছিলো কবি ফিরে আসুক সবার মাঝে। কিন্তু ভক্ত পাঠকদের কাঁদিয়ে তিনি নিজের কথায় ফিরে গেলেন ‘এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙ্ক্ষার খেই../ শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারি গাড়ি’ (কবিতা: নগর ধ্বংসের আগে)।
কবি রফিক আজাদের মত কীর্তিমান সাহিত্যিকদের প্রয়োজন অনেক বেশি। তাদের সৃষ্টিশীল কাজের দ্বারা বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার যেভাবে পুষ্ট হয়েছে তারা না এলে যে কি শূন্যতা থেকে যেতো তা সহজে অনুমান করা যায়। বাংলা সাহিত্য তার অবদান ভুলবার নয়। বড় উপকার হতো যদি তিনি আর কিছুদিন আমাদের সাথে থেকে যেতে পারতেন।
রফিক আজাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সে জন্য তাকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। তার অমূল্য কিছু সৃষ্টি বাংলাদেশের কবিতাকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে। যদিও তার শব্দ চয়ন ও প্রকাশ ভঙ্গি হয়তো অনেকের সব সময় পছন্দ হতো না তবুও তিনি কবিতার পাঠক তৈরি করেছেন এবং তার রয়েছে অগণিত ভক্ত। কবির মৃত্যুতে তাই তার ভক্তকুল আজ শোকে আচ্ছন্ন। সঙ্গত কারণে কবির মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা স্তর থেকে শোক বাণী পাঠিয়েছেন। কবিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়েছে বাংলাদেশ।
যৌবনে রফিক আজাদ ছিলেন বাংলাদেশের কাব্য-আন্দোলনের (স্যাড জেনারেশন) অন্যতম সংগঠক। তখন তিনি লিখেছিলেন ‘একটি চুমুর বিনিময়ে একটি কবিতা উৎসর্গ হবে’। তাকে ভালোবাসার কবি বলতে অনেকে পছন্দ করেন।‘ভালোবাসা মানে এঁকে অপরেরে প্রতি খুব করে ঝুঁকে থাকা.. ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালার সামনে অবিরল কথা বলা’ (কবিতা: ভালোবাসার সংজ্ঞা)
‘যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে / মখমল দিন পাব / যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো / আর সমুদ্র সাঁতরাবো’ (কবিতা: যদি ভালবাসা পাই ) কবি রফিক আজাদের ভাবনায় সমাজ ও মানুষের ইতিবাচক বক্তব্য প্রাধান্য পেয়েছে অনেক বেশি। তার জীবনবাদী কবিতাগুলোতে তিনি এভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছেন; ‘সমাজও ছিলো না তার, বলতে গেলে, সামান্য প্রভাবও; / লোকটির কোন গুণই, কোনদিন, সমাজ দ্যাখেনি। / শরীরে অসুখ ছিল- ছিলো না চোখের কোনো দোষ, / এবং জিহ্বাও তার অসম্ভব অনাড়ষ্ট ছিলো / শেষোক্ত দোষের জন্য লোকটির মৃত্যুদণ্ড হয়’। (কবিতা: লোকটি তবে কবি ছিলো?)
দেশপ্রেমের দ্যুতি তার বিভিন্ন কবিতায় জ্বলজ্বল করে ফুটে ওঠে। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন আমরা যেন তাকে বিশ্বের এ-দেশে সে-দেশে খোঁজার বৃথা চেষ্টা না করি। তাকে বরং পাওয়া যাবে কোথায় তিনি সেটা বলেছেন এভাবে ‘আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ঠেকে আছে পদ্মার ওপর, এবং আমার দু’চোখের অবিরল ধারা বয়ে গিয়ে কানায়-কানায় ভ’রে দিচ্ছে সব ক’টি শুষ্ক নদী, এবং দেখতে পাবে, শ্যামল শস্যের মাঠ আমার বুকের নিচে আগলে রেখেছি…’ (কবিতা: আমাকে খুঁজো না বৃথা) কবি রফিক আজাদের কবিতায় এসেছে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র, রাজনৈতিক উচ্চ বিলাসীদের মানবিক সঙ্কট।
তার কবিতায় আমরা পেয়েছি ভগ্ন হৃদয়ের ছোঁয়া। কর্ম-বহুল জীবন থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতা, সাহিত্য আড্ডা, অবহেলিত সমাজ জীবনের নানান চিত্র, মানব প্রেম এবং নিজস্ব চিন্তা চেতনাকে তিনি কবিতাতে তুলে এনেছেন। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী রফিক আজাদ সম্পর্কে লিখেছেন; ‘রফিক আজাদের গত পঞ্চাশ বছরের নির্মাণ- বয়সে কোন উৎসবিন্দু থেকে নির্ঝরিত? বিষয় নির্বাচনের আট কুঠুরি নয় দরোজার কখন কোনটি বন্ধ এবং কোনটি খোলা? সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দুরূহ। তবু বলা যায়, রফিক আজাদ সৌন্দর্যের মাত্রাসঙ্গমে পারঙ্গম। তার কবিতার নারী-চরিত্র প্রেমের ট্রাজেডিই বহন করে। শিল্প ও ক্ষুধার দ্বৈত আহ্বানে আধুনিক মন হয়ে ওঠে দ্বন্দময়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)।
কবি রফিক আজাদের কবিতাগুলোর মধ্যে থেকে স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় লেখা ‘ভাত দে হারামজাদা’ বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। কবির মৃত্যুর পর অনেকে তাকে বলছেন ‘ভাত দে হারামজাদা’ খ্যাত কবি। কেউ কেউ বলেছে ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আসলে কি তাই? একটি কবিতা কি কাউকে অমর করে রাখতে পারে! ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতা আলোড়ন তুললেও তিনি এর থেকেও অনেক ভাল কবিতা লিখেছেন আমাদের জন্য। সে সমস্ত কবিতার চিত্রকল্প নান্দনিক দিক থেকে অনেক উঁচু। কাজেই কবি রফিক আজাদকে দ্রোহের কবি প্রেমের কবি কিংবা যুগের কবি বললেও ভাল শোনায় কিন্তু ‘ভাত দে হারামজাদা’ খ্যাত কবি বলা কতটা যুক্তি সঙ্গত? বাস্তবতা হলো অনেক দেরিতে হলেও তিনি এই কবিতা লিখে অনুতপ্ত হয়েছিলেন।
টরেন্টোর এক শিল্পী দম্পতির ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কবিকে খুব কাছে পেয়েছিলাম আমরা। সেখানে তাকে এই কবিতাটি পড়তে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেছিলেন ‘আমি এই কবিতা এখন কোথাও পড়ি না’। নিজের সৃষ্টির প্রতি যার এত অনীহা তাকে সেই কবিতার সাথে জড়িয়ে সম্মান না দেখালে হয়তো কবির প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা প্রকাশ পাবে। ব্যাপারটা বুঝত হয়তো আরো একটু আলোকপাত করতে হবে, তার আগে কবিতাটি দেখে নেয়া যাক।
ভাত দে হারামজাদা ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি, উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে অনুভূত হতে থাকে – প্রতিপলে – সর্বগ্রাসী ক্ষুধা অনাবৃষ্টি যেমন চরিত্রের শস্যক্ষেত্রে জ্বেলে দেয় প্রভূত দাহন – তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবি অনেক অনেক-কিছু চেয়ে নিয়েছে, সকলেই চায় বাড়ি, গাড়ী, টাকাকড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে আমার সামান্য দাবি, পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-ভাত চাই-এই চাওয়া সরাসরি – ঠাণ্ডা বা গরম, সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে কোনো ক্ষতি নেই – মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি! অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা-চাইনি তো নাভিনিম্নে পড়া শাড়ি, শাড়ির মালিক; যে চায় সে নিয়ে যাক-যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও জেনে রাখো, আমার ও সব এ কোন প্রয়োজন নেই। যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি, তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যাবে; ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন -সম্মুখে যা পাবো খেয়ে নেবো অবলীলাক্রমে; থাকবে না কিছু বাকি –চলে যাবো হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধর, পেয়ে যাই -রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে। সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে! দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা, গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত, চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী, উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী-আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ। ভাত দে হারামজাদা,তা না হলে মানচিত্র খাবো।
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে কিছু লোক লুটপাট এবং দখলদারিতে মেতে উঠেছিলো এ কথা সত্য। আর এটাও সত্য যে দেশের প্রথম সরকার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চক্রান্তে দিশেহারা হয়ে উঠেছিলো। রাজনৈতিক পালা বদলের জন্য ১৯৭৪ সালে চক্রান্তকারীদের দ্বারা সৃষ্ট হলো দুর্ভিক্ষ। আর সেই দুর্ভিক্ষের সময় কবি প্রকাশ করলেন এই ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতা। এক অজানা কারণে তখন চারিদিকে পাঠ হতে লাগল এই কবিতা। কবি নিজেও খুব গর্বভরে পাঠ ও প্রচার করতেন ‘ভাত দে হারামজাদা’।
সেই থেকে তাকে বহুবার এই কবিতা এবং কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিলো, কাকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন ‘হারামজাদা’? যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রফিক আজাদ মারা গেলেন সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা ভাষাতে তো বটেই এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অগুনিত কবিতা গান, প্রবন্ধ রচনা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন। রফিক আজাদ ‘ভাত দে হারামজাদ’ বলে যে ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলেন তিনি কি তখন জানতেন চল্লিশ বছর পর সেই ব্যক্তির নামেই স্থাপিত হাসপাতালে শুয়ে চোখ বুজতে হবে তাকে। তাই প্রশ্ন জাগে, রফিক আজাদ কেনো নিজ দেশে বসে নিজ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘হারামজাদা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন? শেখ মুজিবের সমালোচক অনেক, এখনো অনেকে তার শাসন আমলের দোষত্রুটি নিয়ে বিরামহীন লিখে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব বরেণ্য নেতা। তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা। শত্রুর মুখ দিয়েও এমন কথা উচ্চারিত হয়নি যে কথা একজন মুক্তিযোদ্ধা কবি উচ্চারণ করেছিলেন।
কবিতায় প্রতিবাদের যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা কি সর্বগ্রাসী বুর্জুয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নাকি নিপীড়িত জনতার কথা বলতে গিয়ে কবি তার নিজের কথার প্রতিধ্বনি তুলেছেন কবিতার শিরোনামে। বঞ্চিত মানুষের পক্ষে সুবিধাবাদী উচ্চবিত্তকে ধমক দিলে ক্ষতি ছিল না বরং তাতে বক্তব্য আরো তীব্র হতো কিন্তু একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লেখাতে এই কবিতা রাজনৈতিক ভাষণ ছাড়া আর কিছু নয় ব্যাপারটা বোঝার জন্য পাঠক হয়তো কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি স্মরণ করতে পারেন কাজেই যে বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে “উদ্ধত আচরণ” করা হয়েছে সেই বঙ্গবন্ধু তো আজীবন শোষিতের পক্ষে ছিলেন। ‘পৃথিবী দুইভাগে বিভক্ত, একদল শোষক আর একদল শোষিত। আমি শোষিতের দলে’ (বঙ্গবন্ধু) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে এক কোটি লোক মারা গিয়েছিল এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর আনুমানিক পঞ্চাশ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়াও বিদেশী শাসন আমলে নানান দুর্ভিক্ষ মহামারিতে প্রচুর লোক মারা যাবার কথা শোনা যায়।
কোন কবি কি সেই সমস্ত মৃত্যুর জন্য বিদেশী শাসককে ‘হারামজাদা’ বলে গালি দিয়েছেন? বাঙালি নিধনের গুরু ইয়াহিয়া খান কিংবা তাদের এদেশি দোসরদেরকে মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ কি ‘হারামজাদা’ বলেছেন, কিংবা তার থেকেও শক্ত ভাষায় কিছু প্রতীবাদ? যদি না বলে থাকেন তবে কেনো বঙ্গবন্ধুকে তিনি এমন করে আক্রমণ করেছিলেন? ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায় ‘অপভাষায় প্রকাশিত ক্রোধ’ বলে হুমায়ুন আজাদ উল্লেখ করেছিলেন। আসলে কবিতাটির বিষয়ে এটাই সবচাইতে সঠিক পর্যবেক্ষণ বলে আমি মনে করি। এর সাথে হয়তো আর একটু যোগ করে বলা যেতে পারে বিশ্বব্যাপী বুভুক্ষু জনতার জন্য একটি কবিতা হতে পারত ‘ভাত দে হারামজাদা’ কিন্তু রফিক আজাদ এই কবিতায় সময়ের প্রতিচ্ছবি তুলতে গিয়ে ব্যক্তিগত ক্রোধের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বিধায় এই কবিতা বিতর্কিত।
যে মহান ব্যক্তিকে তিনি আঘাত করেছেন একমাত্র রফিক আজাদ ছাড়া কেউ এতো বড় গালি তাকে দেয় নি। বঙ্গবন্ধু তার সংগ্রামী জীবনে কখনো এমন কোন কাজ করেন নি যে তাকে ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপানো দুটো ছবি দেখে এই গালি দেয়া যেতে পারে। দেশ স্বাধীন হবার পর অস্ত্র হাতে যারা আন্ডারগ্রাউন্ড খুনির বেশে ঘুরে বেড়িয়েছে সেই সিরাজ শিকদার আর জাসদের গণবাহিনীর সদস্যদের মুখে মুখে রফিক আজাদের এই কবিতা স্লোগানের মত উচ্চারিত হয়েছিল। এই দল দুটি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ঐক্যের যে কি ক্ষতি করেছে সে কথা এখন সকলের জানা হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তথা আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতিশোধ নিতে নানা পথ অবলম্বন করেছিল। তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই খাদ্য ঘাটতি এবং দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিলো। অথচ এই চক্রান্তকারীদের হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন কবি রফিক আজাদের কবিতা।
মনে রাখতে হবে আজকের হলুদ সাংবাদিকতার প্রথম ধাপ ছিল ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। সে সময়গুলোতে তথ্যমন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অন্যতম পরিকল্পনাকারী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। মিডিয়াগুলোতে তখন যে মিথ্যা প্রচার হয়েছিলো আজ তা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। যে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু এবং তার পুরো পরিবারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বলেছিল ‘ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে এলাও করা ঠিক হয়নি, এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিৎ ছিলো লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া’। এমন ব্যক্তি যদি তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রীর পদে থাকে তাহলে মিডিয়াকে কি পরিমাণ অপপ্রচারে ব্যবহার করা হতে পারে সেটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। কবি রফিক আজাদ যখন লিখেন ‘অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি, নেই যৌন ক্ষুধা’ তার এই কথাগুলো আমাদের ভিন্ন ভাবনাতে নিয়ে যায়। সাধারণত; যাদের ভাতের ভয়াবহ ক্ষুধা থাকে তারা যৌন ক্ষুধার কথা চিন্তা করে না। তাহলে ভাতের জন্য যৌন ক্ষুধাকে বিসর্জন কে দিতে চেয়েছিলো? নিশ্চয় ভাত লোভী এবং যৌন ভোগী দুটি শ্রেণী ভুলক্রমে একত্রিত হয়ে গেছে এই কবিতায়।
এরপর তিনি লিখেছেন ‘চাইনি তো নাভিনিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক। যে চায় সে নিয়ে যাক, যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে দাও। জেনে রাখো; আমার ও-সবে কোন প্রয়োজন নেই’। আরো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এগুলো ফুটপাথের ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠীর মুখের কথা ছিলো না। আমাদের সমাজের বঞ্চিত কৃষক শ্রমিক এভাবে চিন্তাভাবনা করে না। তাই কবির কণ্ঠে শাড়ি কিংবা শাড়ির মালিক বলতে বিশেষ এক শ্রেণীর পুরুষদের কথা উঠে এসেছে এবং আমরা জানি এই পুরুষগুলো কারা। হাজার বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়ে একটি দেশ সোজা হয়ে না দাঁড়াতেই ভাতের জন্য এমন চিৎকার কেন? বাংলার মানুষ অপেক্ষা করে বসে ছিলো নিজস্ব স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ এবং মানচিত্রের জন্য। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো ১৯৭১ সালে। আর ৭২ সালের পর থেকেই শুরু হয় সিরাজ শিকদারের জোতদার খতমের নামে গলা কাটার রাজনীতি। এরপর এলো জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে সৈনিকেরা ‘গণবাহিনী’ নাম ধারণ করে। এরাও হাতিয়ার বাহিনী হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। যদিও পরবর্তীতে ‘জাসদ’ স্বীকার করেছে তাদের সশস্ত্র রাজনীতিতে নামা ছিল ভুল কাজ।
এই ভুল স্বীকার অনেক পরে অনেক দেরিতে করা হয়েছে। কেননা ততদিনে সরকারি দল এবং নিজ দলের প্রচুর হতাহতের মধ্যে দিয়ে আতুর ঘরের দুর্বলতার সুযোগে বাংলাদেশ- বহিঃশত্রুদের নজর কেড়ে নেয়। সিরাজ শিকদার বাহিনী এবং জাসদ বাহিনী হাতে দেশের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে তার সাক্ষী দেবে ইতিহাস।
অতি বিপ্লবীদের রাষ্ট্র ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তলে তলে শিল্প-সংস্কৃতির গায়ে কুঠার হানার পরিকল্পনা করে বসে পাকিস্তান প্রেমিক বিদেশি চক্র। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল আপোষহীন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই দেখা দিল ষড়যন্ত্রের ভেতর আর এক ষড়যন্ত্র। যাদের যোগাড় করা হল ভুয়া বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে, তাদের পাশ কাটিয়ে চলল অন্য পক্ষকে ক্ষমতায় বসানোর নীল নক্সা। শেখ মুজিবকে চিরতরে সরিয়ে দিতে তাদের বোঝানো হল এটা হবে স্বাভাবিক সামরিক অভ্যুত্থান। এদের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে রইল চরম প্রতিশোধ গ্রহণকারী আর একটি চক্র। ভাত দে হারামজাদা কবিতায় যার উল্লেখ আছে, ‘তোমার সমস্ত রাজ্য দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যাবে’। তাহলে দাঁড়ালো মোট চারটি দল। একটি দলকে মাঠে নামানো হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং শোষণ মুক্ত সমাজ কায়েমের রাজনৈতিক চমক ধরিয়ে। অন্যপক্ষকে বলা হল দেশের জন্য সামরিক অভ্যুত্থান প্রয়োজন। তৃতীয় দল হল প্রকৃত জল্লাদ বাহিনী। আবারো সেই কবিতার অংশ মিলিয়ে নেয় যাক, ‘যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধরো পেয়ে যাই’, এখনে প্রশ্ন হল- কি হবে পেয়ে গেলে? কবিতাতেই সেটা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, ‘রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে’। বোঝা যাচ্ছে এ ক্ষুধা তাহলে ভাতের ক্ষুধা না, ক্ষুধা ছিল রক্তের ক্ষুধা।
রাক্ষস রক্ত খায় সেটাই তার খাবার। কে সেই রাক্ষস বা রাক্ষসেরা। পরিষ্কার হয় পরের পঙক্তিতে, ‘দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে (একত্র করে বলা যেতে পারে ‘ইতিহাস কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টা) অবশেষে যথাক্রমে খাবো, গাছপালা নদী-নালা গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত’। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বা চতুর্থ দল তাদের নিয়ে গঠন করা হল যারা ইতিহাসের চাকা, সংস্কৃতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আজব এক বাংলাদেশ গঠন করবে, যে বাংলাদেশ চলবে ‘উটের পিঠে’। এরাই পরবর্তীতে মানচিত্র খেয়ে ফেলতে চাইল, পতাকা খেল। ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পানি ঘোলা করে দিল। এরপর বাংলাদেশ কিছুদিনের জন্য হয়ে গেল যেমন খুশি তেমন দেশ। ফিরে আসি ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায়।
‘নাভিনিম্নে শাড়ি’ না চাওয়া কণ্ঠ যে স্বপ্ন বিলাসী হতাশা আচ্ছন্ন কিছু যুবকের কথা সেটা হয়তো সকলেই মেনে নেবেন। আসুন আর একবার দেখে নিন কবিতার চুম্বক অংশ। ‘ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি; উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে…অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায় / বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি -কারো বা খ্যাতির লোভ আছে / আমার সামান্য দাবি পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর। ‘ভাত দে’ এর সাথে এই কথাগুলো কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? একজন কবি হিসাবে রফিক আজাদ তো সমাজের হতাশাগ্রস্ত যুবকদের ধৈর্য ধরার কথা বলতে পারতেন।
ক্ষুধার্ত মানুষদের পক্ষে ভিক্ষুকের মত ভাত না চেয়ে অধিকার আদায়ের পথ দেখাতে পারতেন। অন্যের কাছে ভাত চাওয়াকে খুব সম্মানজনক বলবো না। তবে ভাত সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সেই প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে অবশ্যই কণ্ঠকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই কবি বলতে পারতেন কিভাবে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। মানুষ কি এই দুনিয়াতে শুধু খেতেই এসেছে? ‘দু’বেলা দু’মুঠো হলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবি’ / ঠাণ্ডা বা গরম / সরু বা মোটা রেশনের লাল চাল হলে কোনো ক্ষতি নেই…। তিনি প্রতিবাদী হয়েছেন কিন্তু সাথে সাথে পক্ষও নিয়েছেন।
এই পক্ষ সেই ভুল রাজনীতি বা ‘জাসদ’ কিংবা সিরাজ শিকদারের পক্ষে চলে যায়। একথা এ জন্য বলছি কেননা সাধারণত কবিদের প্রতিবাদ হয় নান্দনিক এবং অহিংস। যেমন ধরুন ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য)‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি’ (রুদ্র মোঃ শহীদুল্লাহ) কবি আল মাহমুদও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে গালাগালি না করেই লিখেছেন,“শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা / আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি / নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না / আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর! (কবিতা: রবীন্দ্রনাথ) ভাতের অভাব আমাদের সব সময়ই ছিল। গল্প উপন্যাস ইতিহাস জ্বলন্ত সাক্ষী যে আমাদের অঞ্চলের লোকেরা ক্ষুধার কষ্ট কি করে সয়ে এসেছে। এই কষ্ট হাজার হাজার বছরের পুরানো। ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হতে না হতেই ক্ষুধার জন্য মানচিত্র পতাকা খেয়ে ফেলা এবং জাতির পিতাকে গালমন্দ করা মানে মুল খুঁটিকে নাড়া দেওয়া।
বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই জনগণের কথা বলতে গিয়ে কবিরা কিভাবে রূপক ভাষায় কথা বলেছেন। তারা ভিন্ন উপমাতে প্রতিবাদী হয়েছেন। অথচ অতীত বলে দিচ্ছে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পক্ষে ঘি ঢালার কাজ করেছেন ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতা। আমার মতে কবি রফিক আজাদ এই কবিতা লেখার আগে ৭৪ সালে সার্বিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করলে ভাল করতেন। তিনি নিজেও কিন্তু অপেক্ষা এবং পরিবর্তনের কথা তার অনেক কবিতাতে উল্লেখ করেছেন। ‘এমন অনেক দিনে গেছে / আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি / হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে / নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে- কোন বন্ধুর জন্য / কিংবা অন্য অনেকের জন্য / হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো’ (কবিতা: প্রতীক্ষা) ‘আমি অপেক্ষা করছিলাম / একজন নারীর জন্য, সম্পূর্ণ রমণী/ যার স্পর্শে এই পাথর সোনা হয়ে উঠবে / ব্রোঞ্জ, তামা আর দস্তার সমারোহময় এই দেশ’। (কবিতা: কোন এক নারীর জন্য) ‘আমার বুকের মধ্যে জেঁকে বসা একটি পাথর বিশ বছর পর নিঃশব্দে নেমে গ্যালো (কবিতা: তুমি বিশ বছর আগে ও পরে) ‘আমি তো অপেক্ষা জানি; এই খররৌদ্রে কখনো কি প্রিয় বান্ধবীর লেখা চিঠি খোলা চলে? (কবিতা: বৃষ্টি) ‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে / নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে। / চুনিয়া বিশ্বাস করে / শেষাবধি মানুষের হিংসা-দ্বেষ ভুলে / পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে’ (কবিতা: চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)‘এতো তাড়াহুড়ো করো না হে, ধীরে বয়ে যাও, তোমার চলার পথে পড়বে অনেক বৃক্ষ- সবুজ, সতেজ’ (কবিতা: জীবন একটি নদীর নাম) উল্লেখিত অংশগুলো থেকে বোঝা যায়, অপেক্ষা এবং আশাবাদী হওয়াতে কবি রফিক আজাদও বিশ্বাসী ছিলেন।
তাই প্রশ্ন জাগে, ‘ভাত দে হারামজাদা’ লিখে তিনি কি অনুতপ্ত? এই কবিতা কি তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে লিখেছিলেন কিংবা কাউকে উদ্ভূত করতে ধরেছিলেন কলম? এ প্রশ্নের উত্তর জানবার আগে তারই লেখা ‘নত হও, কুর্নিশ করো’ কবিতার কিছু অংশ দেখে নেয়া যাক। তোমার উদ্ধত আচরণে চেয় দ্যাখো, কী যে দুঃখ; পেয়ছেন ভদ্রমহোদয়গণ।:অতএব নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো; কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার।..হটাত কেন যে হলো তোমার দুর্মতি ক্ষুধা পেলে ভাত চাও, হওয়া-খাওয়া পছন্দ করো না…আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জাতির পিতাকে ‘হারামজাদা’ বলে তিনি বহু বছর পর্যন্ত অনুতপ্ত হন নি বরং যা বলেছেন ঠিক করেছেন তেমনটি বোঝা যাচ্ছে। তবে, আসল কথা হল দেরিতে হলেও কবি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং অনুতপ্তও হয়েছেন। তা না হলে তিনি বলতেন না, ‘আমি এই কবিতা এখন কোথাও পড়ি না’। ‘রাগারাগির কিছু পদ্য লিখে আমি / সামান্য বদনাম কিনেছি’।
এক সাক্ষাৎকারে কবি রফিক আজাদ বলেছেন: ‘আমি তো মনে করি, আমার আত্মজীবনী লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার কবিতার মধ্যেই ধারাবাহিকভাবে আমার জীবন আছে’… হতাশা-হাহাকার হৃদয় বিদীর্ণ করা বেদনাও আছে জীবনে। সেইসবের ছায়াপাত তো কবিতায় পড়বেই… জীবন তো আসলে কবিতা নয়, কবিতা করে তুলতে হয়। ২০১৫ সালের ৩ জুন মাসে স্বকৃত নোমানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কবি রফিক আজাদ একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এইভাবে;‘বাঙালি আসলে মহৎ জাতি। বাঙালির আবেগ আসলে মহৎ আবেগ। এই আবেগ না থাকলে অনেক কিছুই হতো না। বাঙালির সৎ গুণের একটি হলো, হাজার হাজার বছর আগে এই জাতি বিপুলভাবে আবেগে জেগে উঠেছিলো বলে একটি দেশ তৈরি করতে পেরেছিল। দেশ তৈরি করার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক ছিলো।
টোটাল নেতৃত্ব দেওয়ার মতো এক ব্যক্তি, যার মধ্যে সব গুণই ছিল, তিনি সেই নেতৃত্বটা দিতে পেরেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবার আবেগ তার মধ্যে পেয়েছিল সবাই। সবার হয়ে তিনি কথা বলেছিলেন। তার কথাতেই তার অনুপস্থিতিতেও নয়টি মাস তার নামে, তার একটি বক্তৃতায়, তার আদর্শে মানুষ যুদ্ধ করেছে। এই যে বিপুল আয়োজন, এটা তো বিশাল ব্যাপার। তখন দেখা গেল, এক কোটির বেশি যুদ্ধে চলে গেল। বাড়িঘর, সংসার সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। কদ্দিন থাকতে হবে, তা তারা জানতেন না। এটা একটা বিস্ময়কর জাতি।
কাজেই এ জাতির বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। এ জাতিতে আমি জন্মগ্রহণ করেছি বলে আমার কোন খেদ নেই। আমি নিজেকে গর্বিত বাঙালি মনে করি’। ইমদাদুল হক মিলনের একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি; ‘রফিক আজাদ জাঁদরেল মুক্তিযোদ্ধা। কাদের সিদ্দিকীর সহকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কবিতা লিখে দেশ কাঁপিয়ে দিলেন। ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায়। কবিতা চলে গেল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। সরাসরি তাকেই আক্রমণ। পুলিশ ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি মহল তৎপর হয়ে উঠল।
বঙ্গবন্ধু কানে গেল এই ঘটনা। তিনি রফিক আজাদকে ডেকে স্নেহের ধমক দিলেন। সংশয় কেটে গেল। বন্ধুরা ধরে নিয়েছিলাম কবিতা লেখার অপরাধে রফিক আজাদকে জেলে যেতে হবে’। (বাংলা লাইব্রেরি, জানু ০৮, ২০১০) কবি রফিক আজাদের সাথে শিমুল সালাহউদ্দিনের ২০১৬ সালে নেয়া নির্বাচিত সাক্ষাৎকারে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই সাক্ষাৎকার থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি।
শিমুল সালাহউদ্দিনঃ রফিক ভাই, এই বইয়েরই (সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে -১৯৭৪ সাল) তো কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’, তাই না?
রফিক আজাদ: (হাসি) হা হা হা, তুমি তো দেখি আমারে ভাজাভাজা কইরা ফালাইছো… হ্যাঁ এই কবিতা নিয়া বঙ্গবীর আর বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত গড়াইলো আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। তবে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারছিলেন যে কবি এইটা লিখতে পারে। আসলে কি, কেউ কেউ এই কবিতাটার ভুল ব্যাখ্যা করেছিল।
শিমুল সালাহউদ্দিনঃ আচ্ছা রফিক ভাই, আপনার সবচেয়ে বেশি মানুষের মুখে মুখে ফেরা কবিতা তো – ভাত দে হারামজাদা- সবচেয়ে বেশি রিডেড আউট, স্প্রেডেড আউট- এই কবিতাটার প্রেক্ষাপটটা যদি বলতেন।
রফিক আজাদ: প্রেক্ষাপট চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ। বিশেষ করে দুর্ভিক্ষ যতটা হোক না হোক, মিডিয়া একটা চক্রান্ত ছিল, যেমন জাল পরিয়ে বাসন্তীকে দেখানো হইছে, ইত্তেফাকে, যেন না খেয়ে অভাবে জাল পরে আছে – শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে ইত্তেফাকের ফটোগ্রাফার আফতাব তাকে একশো টাকা দিয়া জাল পরাইছে, তেমনি আরেকটা দৃশ্য আছে রংপুর স্টেশনে কেউ বদহজম হইছে, বমি করেছে, সেই বমির উপর একটা ক্ষুধার্ত লোককে –তাকে বলা হয়েছে যে
শিমুল সালাহউদ্দিনঃ তুই মুখ লাগাবি রফিক আজাদ: হ্যাঁ, মুখ লাগানোর চেষ্টা করবি। লাগাতে হবে না, একশো টাকা পাবি। এগুলা সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক ছাপ ফেলেছে, তাদের মনে প্রচণ্ড ক্রোধ জমে গেছে। আমারও। তো এই ক্রোধ থেকেই ‘ভাত দে হারামজাদা’ লেখা।
শিমুল সালাহউদ্দিনঃ চুয়াত্তরে আপনি লিখলেন ‘ভাত দে হারামজাদা’ বঙ্গবন্ধু হলো, তখন হলো প্রেসিডেন্ট এবং এই ঘটনায় আপনার অনেক বন্ধুরাই ভেবেছিল আপনাকে বুঝি না জেলে যেতে হয়।
রফিক আজাদ: বুঝি মেরে ফেলবে…না টেনশন তো বটেই…ভাগ্য ভালো, মানে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী আর আনোয়ারুল আলম শহীদ- এরা যোদ্ধা তো- আমি যুদ্ধ করছি তাদের সাথে- বঙ্গবন্ধুর কাছে আমারে নিয়ে গেছিলেন। উনি ব্যাখ্যা চাইলেন। আমি ব্যাখ্যা দিছি- সারা পৃথিবীর নিরন্ন মানুষের প্রধান চাওয়া হলো ভাত। আমি সারা পৃথিবীর লোকের কথা বলছি। আমাদের দেশে, নিরন্ন মানুষ এই ভাষাতেই কথা বলে। এটা বলার পর উনি বলে, ‘তা বটে’।
শিমুল সালাহউদ্দিনঃ হা হা হা। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তা বটে’! রফিক আজাদ: হ্যাঁ। আমার কাঁধে হাত রাইখা বলল, ‘ভালো লিখছিস, যাহ। তুই ইয়ের কাছে যা, উনি মনসুর আলীর কাছে পাঠাইলো (ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন), ফোন করলেন আমার সামনেই, ফোনে বললেন, এই যে ওরে পাঠাইলাম, ওর কথা শুইনা ওরে ছাইড়া দিও’। এই হলো আমাদের বঙ্গবন্ধু।
অামেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলের টাকায় ভাসতে থাকা দেশগুলো যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অসহযোগ ঘোষণা করে (‘বাংলাদেশ একটি তলা বিহীন ঝুড়ি’) কোণঠাসা করে রেখেছিল এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে উত্তপ্ত করে তুলেছিল দেশ। সেই বঙ্গবন্ধু বিদেশী রাষ্ট্র এবং অভ্যন্তরীণ চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মুহূর্ত শুনতে পেলেন এক কবি তাকে গালাগালি করে কবিতা লিখেছে। স্পষ্ট ভাবে তাকে ‘হারামজাদা’ বলার পরও তিনি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন, কবির ভাষা এমন হতেই পারে। একজন কবির প্রতি শ্রদ্ধা বোধ থেকেই তিনি নিজ হাতে ফোন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন কবিকে ছেড়ে দিতে।
অর্থাৎ তার কোন অভিযোগ নেই কবির বিরুদ্ধে। এখানেই বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব, তিনি নিজগুণেই শ্রেষ্ঠ, এর জন্য কোন মতামত জরিপ লাগে না, লাগে না বিদেশীদের সার্টিফিকেট।তিনি দরদ দিয়েই বুঝতেন তার দেশের মানুষকে। বিশেষ করে কবিতা এবং কবিদের প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। যে কবিকে বঙ্গবন্ধু ভালবাসা দিয়েছেন এবং দেরিতে হলেও কবি সেই মহান ব্যক্তিকে চিনতে সক্ষম হয়েছিলেন, এখন কি আর রফিক আজাদকে বলা উচিৎ ‘ভাত দে হারামজাদা’ খ্যাত কবি? কবির শ্রেষ্ঠত্বকে কোণঠাসা না করে আসুন আরো বিস্তার করি, তাতেই রয়েছে কবিকে ভালোবাসা তৃপ্তি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)