চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

যে পথে অনন্য হুমায়ূন

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের ছোটগল্পে আমরা দেখতে পাই, ছোটগল্পের বক্তব্যকে ছাপিয়ে নির্মিতির বিষয়টি গুরুত্ব পেতে। এই সময় বাংলাদেশের সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১৩)-এর আবির্ভাব ঘটে। তবে সেই খ্যাতি তিনি পেয়েছেন ছোটগল্প লিখে নয়, উপন্যাসে। ছোটগল্প হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে কম চর্চিত ও কম পঠিত একটি অধ্যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের আবেগ অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে এই ছোটগল্পেই।

ছোটগল্পে হুমায়ূন আহমেদ তার সাহিত্যচর্চার বিকল্প পথ ধরে হেঁটেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন তার শ্রেষ্ঠগল্প গ্রন্থের ভূমিকাতে- ‘লিখতে আমার কখনো ক্লান্তি লাগে না। যতক্ষণ লিখি গাঢ় আনন্দে মন ভরে থাকে। অবশ্য সব লেখার জন্যে এটা সত্যি নয়। ছোটগল্পের কথাই ধরা যাক। এরা আমাকে খুব কষ্ট দেয়।’ [হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠগল্প, অনিন্দ্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮] অর্থাৎ, ছোটগল্প ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের গোপন ব্যথা থেকে উৎসারিত হয়েছে। নিশ্চয় তিনি ভৌতিক, অলৌকিক ও কল্পকাহিনীমূলক গল্প লিখেছেন। কিন্তু তার ছোটগল্পের মূল জায়গা হল, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জীবনবেদনা। অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত গল্প কিংবা কল্পকাহিনীতে এসেও আমরা তাকে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তদের সংকটকেই উপজীব্য করে তুলতে দেখি।

Bkash July

আমার কাছে এই মুহূর্তে হুমায়ূন আহমেদের দুটি ছোটগল্পের সংকলন আছে। একটি ‘হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠগল্প’ -এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে। এখানে গল্প আছে ৩২টি। সবগুলোই সিরিয়াস গল্প। আর ‘গল্পসমগ্র হুমায়ূন আহমেদ’ -বইটির অষ্টম মুদ্রণ বের হয় ২০০৬ সালে, কাকলী প্রকাশনী থেকে। এখানে আছে ছোট-বড় মিলে ৮৫টি গল্প। এই সংকলনের বাইরেও হুমায়ূন আহমেদের কিছু গল্প থেকে গেছে। যেমন হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ তিনটি গল্প ‘চোর’, ‘সংসার’ এবং ‘পাপ’ এদুটি গল্প সংকলনে নেই। ‘চোর’ এবং ‘পাপ’ গল্পগুলিকে তৃতীয় একটি সংকলনে পাওয়া গেলেও ‘সংসার’ গল্পটি কোথাও চোখে পড়েনি।

বিশ্বসাহিত্যের প্রায় সকল মহান সৃষ্টিকর্মই মানুষের গোপন ব্যথা থেকে উৎসারিত। সাহিত্যকে আমরা মোটাদাগে মানুষের যন্ত্রণার আশ্রয় হিসেবে দেখতে পারি। অন্যভাবে যদি বলি, সাহিত্য হল মানুষের মনোরোগের পাঠ, তাহলেও ভুল বলা হবে না। এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্পকে বেছে নেয়া যেতে পারে। শুরু হোক ‘জীবন যাপন’ দিয়েই। এই গল্পের তিনটি প্রধান চরিত্র ভাই-বোন ও দুলাভাই। গল্পকথক কিশোর বয়সের ভাইটি। গল্পটি শুরুই হচ্ছে- ‘আমার দুলাভাই লোকটি খবিস ধরনের।’ -এই বাক্য দিয়ে। এরপর লেখক হুমায়ূন আহমেদ কথকের মুখ দিয়ে তার সহজাত রসবোধ থেকে ‘খবিস’ শব্দটির অর্থ নিয়ে কথা বলছেন। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য পাঠে রস সঞ্চারণের জন্য টনিক হিসেবে এমন খুঁটিনাটি বিষয় উপস্থাপিত হয়। এমন বাড়তি অংশ না থাকলে মূল গল্পের কোনো ক্ষতি হতো না, কিন্তু তাহলে হুমায়ূন আহমেদের স্বকীয়তা বলে কিছু থাকে না। এটা হল তার গল্পের চিহ্নদাগ, প্রায় সব গল্পেই এমন আপাত অপ্রয়োজনীয় অংশ আছে। গল্পকথকের বোনটি বোকা প্রকৃতির। জীবন তাকে বোকা হতে শিখিয়েছে। ছোটভাইয়ের কষ্টে আড়ালে তাকে কাঁদতে দেখি বা নিজের কষ্ট লুকানোর জন্য ননসেন্স বা বেকুব টাইপের আচরণ করে তখন আমরা বুঝতে পারি বোকা সে নয়, বোকা তাকে সাজতে হয়েছে। এর কারণ কেবল দুলাভাই নয়। এই নারীচরিত্রটির সংসারকাষ্ঠে নির্মম পরিণতির ইতিহাস একদিনে রচিত হয়নি। রগচটা দুলাভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তার সংসারে যায় গল্পকথকের বড় বোনটি। বাবা মৃত। মা-সহ চার ভাইবোন ভাগাভাগি করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকে। বাকিটা আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। মাঝরাতে দুলাভাইয়ের সিগারেট কিনতে গিয়ে গল্পকথক ভাবে আর ফিরে আসবে না দুলাভাইয়ের সংসারে। যে অসহায় বোনের মলিন চেহারা তাকে ঘরবিমুখ করে, সেই বোনের কষ্টে মোড়ানো সরল হাসির টান আবার তাকে ফিরিয়ে আনে। গল্প শুরু হয়েছিল নেতিবাচকভাবে। শেষটা হয় এইবাক্যে- ‘বড় ভাল লাগে এই বোকা মেয়েটির হাসি।’ এই হল হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পের ‘হুমায়ূনীয়’ চেহারা। সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, আকাঙ্ক্ষা-নৈরাশ্য পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে থাকে।

Reneta June

‘নিশিকাব্য’ গল্পেও আমরা একইরকম অনুভূতির সাক্ষী হই। আনিস কোম্পানির চাকরি করে। এলাকায় অফিসের কাজে এসে অফিসকে না জানিয়ে রাতটুকুর জন্যে বাড়িতে আসে। যৌথ পরিবার- বাবা, মা, ভাই, বোন সকলেই আছে। আছে স্ত্রী পরী ও শিশুকন্যা। বহুদিন পর আনিস আসাতে ঐ রাতেই বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে যায়। রাতে একদিকে গল্প চলে পরিবারের সকলে মিলে, অন্যদিকে এটাসেটা রান্না করে আনিসের বউটি। গল্পে গল্পে প্রায় রাতটা চলে যায়, এতদিন পরে কাছে এসেও একান্ত করে মিশতে পারে না আনিস ও তার স্ত্রী পরী। একটা শাড়ি এনেছে আনিস পরীর জন্য। ওদিকে বোনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পরী শাড়িটা ননদ রুনুর জন্যে তুলে রাখে। মেয়ের জ্বর। ওরা মেয়ের পাশের বসে খুনসুটি করে কিছুটা। এরবেশি এগোতে পারে না, বেরসিক কাক ডেকে ওঠে, ভোরের ট্রেনটা ধরতে হবে বলে উঠোন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে আনিসের বাবা। গল্পটা টনটনে ব্যথার। কিন্তু মোড়ানো হয়েছে কতগুলো স্বপ্নবাজ মানুষের সরল উচ্ছ্বাস দিয়ে।

‘সাদা গাড়ি’ গল্পটিও সুখ এবং অসুখের। গল্পকথকের সাথে ঘটনাচক্রে সাব্বিরের পরিচয় হয়। সাব্বির বড়লোকের ছেলে। সাদা একটা গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়। গল্পকথক ও তার প্রেমিকাকে অনুসরণ করে। সে সরলভাবে জানায়- ‘আপনাদের দুজনকে এত সুন্দর লাগছিল। কি সুখী সুখী লাগছিল। আমার মনে হল এটা বলা উচিত, আপনি রাগ করেননি তো?’ কিংবা ‘আমি কিন্তু ফুচকা খাবার পর থেকে কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা আপনাদের ফলো করছি।’ গল্পের পরিণতিতে এসে গল্পকথকের জন্য আমাদের মনটা বিষিয়ে ওঠে- ‘নীলুর সঙ্গে শেষপর্যন্ত আমার বিয়ে হয়নি। যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছি সে নীলুর মতো নয়। কিন্তু তার জন্যেও আমি প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুভব করি। বৃষ্টির রাতে যখন হটাৎ বাতি চলে যায়…। তখনই মনে হয় কাছেই কোথাও সাদা গাড়িটি বৃষ্টিতে ভিজছে। চশমা পরা অসুস্থ যুবক ভুরু কুঁচকে ভাবছে, মানুষ এত সুখী কেন?

‘অপরাহ্ণ’ গল্পটি এক রিকশাচালককে নিয়ে। রিকশায় যিনি চড়েছেন, যার দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটি বলা, তিনি ইসহাক সাহেব। যে রিকশাটা চালাচ্ছে তার নামও ইসহাক। আমরা দেখি নগরকেন্দ্রিক মানুষের মন সবকিছুতেই সন্দেহ করে। রিকশায় বসা ইসহাক সাহেব তেমনই এক চরিত্র। স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে কমে গন্তব্যে যেতে সম্মত হওয়াতে তাই রিকশাচালকের বদ মতলব আছে বলে তার ধারণা হয়। রিকশাচালক হঠাৎ করে রাস্তায় পড়ে গেলে তিনি ধারণা করেন কোনো বাহানা করে অতিরিক্ত টাকা দাবি করার ফন্দি এটা। কিন্তু রিকশাচালক সেটি না করে পেট ধরে বলে ওঠে- ‘সাব, আপনে আমার রিকশাটা দেখবেন। গরীব মানুষ রিকশা গেলে সর্বনাশ।’ এরপর তার রক্ত বমি হলে কয়েকজন লোক তাকে হাসপাতালে নেয়। ইসহাক সাহেব দাঁড়িয়ে থাকলেন রিকশার পাশে। কথা দিয়েছেন রিকশাটা তিনি দেখবেন। পিজিতে গিয়ে জানতে পারলেন রিকশাচালক আর বেঁচে নেই। গল্পটি শুরু হয় হালকা চালে। একটা উপভোগ্য রহস্য তৈরি হবে এমন আবহে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যা হল, সেটি আর উপভোগ করার মতো বিষয় নয়।

‘আনন্দ বেদনার কাব্য’ গল্পে এক গ্রামীণ কাঁচা কিন্তু খাঁটি কবি-স্বভাবী কবির কথা জানতে পারি। কবির একটি মাত্র বই ‘রিক্তশ্রী পৃথিবী’ নিজ খরচে প্রকাশিত, ঘটনাচক্রে গল্পকথকের হাতে এসে পৌঁছেছে। বইটির ঘিরে পরিবারের সম্ভাব্য গল্পটি আমাদের শোনাচ্ছেন লেখক। গল্পটি আনন্দ ও বেদনার। কবির প্রথম বই প্রকাশের আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে কবিকন্যার মৃত্যু। এই কন্যাই খুব মমতা দিয়ে বইটির প্রচ্ছদ করেছে, অভাবে সংসারে বইটি প্রকাশিত হতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ায় আর দেখে যেতে পারেনি। কবি তার কবিতা রচনার পেছনের কথা লিখে রেখেছেন কবিতার নিচে নিচে। একটি কবিতা তিনি লিখেছেন তার বাসর রাতে। ঝড়বৃষ্টির সেই রাতে তিনি নতুন বউকে বিছানায় অপেক্ষায় রেখে কবিতা লিখে শুনিয়েছেন। সুখের সে মুহূর্ত তার। কন্যা যখন মৃত্যুশয্যায় তখনও তিনি কবিতা লিখেছেন। ‘মাগো’ কবিতাটির নোট থেকে জানা যায়, ‘মৃত্যুর আগের রাতে সে(মেয়েটি) যখন মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছিল তখন তার অসহায় বাবা এই কবিতাটি লিখে এনেছিলেন মেয়েকে কিঞ্চিৎ উপশম দেবার জন্যে।’ গল্পটি কোনো এক অখ্যাত লেখকের লেখা ‘রিক্তশ্রী পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের অন্যরকম একটা রিভিউ হয়ে আমাদের সামনে আসে।

‘জুয়া’ এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। প্রণব বাবু স্কুলশিক্ষক। তিনমাসের বেতন বন্ধ ফলে পুত্র-কন্যাদের সাধ পূরণ করতে পারেন না তিনি। চা খাওয়ার অভ্যাস আছে, চা জুটলেও চিনি জোটে না। বিপন্ন ছেলে সুবলকে প্রয়োজনে মাত্র তিনশ টাকা দিতে পারেন না। মেয়েও কী একটা ঝামেলায় পড়ে এক হাজার টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠি পড়ে তিনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি। এরমধ্যে তার দুই লক্ষ টাকার লটারি বেঁধে যাওয়ার সংবাদ আসে। সেই লটারি বুকে রেখে ছেলে-মেয়ের সামান্য কটি টাকার চাহিদা মেটাতে না পারার ব্যর্থতায় নিঃস্ব মানুষের মতো কাঁদতে থাকেন এই মাস্টারমশাই। গল্পটি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শিরোনামে পরবর্তীকালে মুদ্রিত হয়েছে। ‘সুখ অসুখ’ গল্পটিও বিষাদের। রহমান সাহেব পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সেবার জন্য আছে পুত্রবধূ। ছেলে বিদেশে। পুত্রবধূ শ্বশুরকে এই অবস্থায় রেখে চলে যেতে পারছেন না। কষ্টে আছে দুজনই।

‘একজন ক্রীতদাস’ গল্পটিও টনটনে ব্যথার। প্রেমিকা পারুল গল্পকথককে বিয়ে করেনি। অন্য একটা ছেলেকে নিয়ে সুখেই আছে বলে ধারণা করে গল্পকথক। একের পর এক ব্যবসায় লোকসান তার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। শরীরটা শুকিয়ে চিনবার উপায় নেই। নিজেকে আরও অচেনা করতে নিজের চলন ও বেশভূষার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। গল্পকথকের নিজস্ব বয়ানে, ‘রাস্তায় আমি মাথা নিচু করে হাঁটি। পরিচিত কেউ আমাকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠুক তা এখন আর চাই না। …অভাব, অনাহার ও দুর্ভাবনা আমার চেহারাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। …লম্বা দাড়ি ও ভাঙা চোয়ালই আমার পরিচয়কে গোপন করার রাখবার জন্য যথেষ্ট ছিল, তবু আমি হাত দুলিয়ে দুলিয়ে অন্যরকম ভঙ্গিতে হাঁটা অভ্যাস করলাম।’ এতকিছুর পরও পারুল তাকে একদিন ঠিকই চিনে ফেলল। গল্পকথকের এই অবস্থা দেখে পারুল নির্বাক অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। গল্পকথক জানান, ‘সমস্ত দুঃখ ছাপিয়ে তাকে হারানোর দুঃখই নতুন করে অনুভব করলাম। আমার জন্যে এই দুঃখটার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।’ এভাবেই দুঃখের ভেতর থেকে নতুন একটা বাক নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলো। জীবন থেমে গিয়ে আবার চলা শুরু করে।

হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প ‘খাদক’ এবং ‘চোর’। ‘খাদক’ গল্পে আমরা দেখি, মতি মিয়া একবসাতে অস্বাভাবিক পরিমাণ খেতে পারে। আশেপাশের গাঁ থেকে ‘খাদক’ পরিচয়ে খ্যাত মতিকে লোকজন ‘হায়ার’ করে বরযাত্রীর হিসেবে যেন ‘মেয়ের বাড়িতে খাবার শর্ট পড়ে।’ মেয়েপক্ষকে বিয়ের দিন হেনস্থা করে বরপক্ষ একধরনের সুখ পায়। গল্পের কথকের সম্মানে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি খোন্দকার সাহেব খাদক মতির ভোজের আয়োজন করে। একটি গরু খাবার বাজি। রাত দশটায় শুরু হয়, শেষ হতে প্রায় সকাল দশটা লাগবে বলে লোকজন বলে। মতি মিয়া যখন খেতে বসে তখন তার হাড্ডিসার ছেলেরা থাকে ‘দেখক’র ভূমিকায়। ওদের খেতে দেয়ার কেউ নেই।

ছেলেদের কথা ভেবে পাঠকের মন বিষিয়ে ওঠে। এই গল্পে সামাজিক কাঠামো ও মানুষের বোধকে স্যাটায়ার করা হয়েছে। হাস্যছলে বলা হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে কঠিন গল্প এটি। গল্পে আমরা স্ট্রাকচারাল আইরনির ব্যবহার দেখতে পাই। যে লোকটার আয়-রোজগার নেই সে খেতে পারে খুব। অভাবের সংসারে খেয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে। লোকটির এই বিশেষ ক্ষমতার কারণে তার অভুক্ত সন্তানদের সামনে তাকে প্রতিযোগিতা করতে হয় নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত খাবার খেয়ে। এর চেয়ে নির্মম জীবন আর হয় না। কিন্তু যে খাদক, ভক্ষণ করা যার প্রতিভা, সে নির্বিকার চিত্তে খেয়ে যাচ্ছে। সে কখনো হারতে চায় না। গল্পকথক কল্পনা করে, খাদক মতি মিয়া হয়ত হার স্বীকার করে নিজের মুখের খাবার অভুক্ত হাড্ডিসার ছেলেদের মুখে তুলে দেবে। কিন্তু সেটি ঘটবে না বলে ধারণা করে ব্যথিত হন গল্পকথক। গল্পটি ভোগবাদী অমানবিক সমাজের এলিগরিক্যাল পাঠ হিসেবে আমরা ভাবতে পারি।

একইভাবে ‘চোর’ গল্পটিও আর সাধারণ গল্প হয়ে থাকেনি। একটি চোর ধরা পড়েছে। গ্রাম্যসালিশে রায় হয়েছে তার চোখ তুলে নেয়া হবে। তাও আবার খেজুরের কাটা দিয়ে। মার খেয়ে চোর মতি বসে আছে বিধ্বস্ত হয়ে। সারা গ্রামের মানুষ জড় হয়েছে চোখ উপড়ে নেয়ার দৃশ্যটি দেখবে বলে। মতি ভাবে, এত এত মানুষের মধ্যে নিশ্চয় কেউ দয়া দেখিয়ে বাধা দেবে। কিন্তু দেখা যায় উল্টো চিত্র- শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ সকলেই অপেক্ষা করছে চোখ তোলার দৃশ্যটি দেখবে বলে। চারপাশের লোকজন আর মানুষ থাকেনি। এই গল্পে বর্তমান সমাজের অপরাধ প্রবণতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ নির্মমভাবে উঠে এসেছে।

আমার নিজের সবচেয়ে প্রিয় গল্প হল ‘সংসার’। গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি মজিদ নামের এক চারবছর বয়সী শিশুকে তার বাবা কুদ্দুস মিয়া খেলার জন্য ইঁদুর ধরে দিয়েছে। ইঁদুরের লেজ বেঁধে দিয়েছে লাল সুতো দিয়ে। মজিদ ইচ্ছে মতো ইঁদুরটি নিয়ে খেলছে, নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু খেতে দিচ্ছে না। ক্ষুধায় কাতর হয়ে ইঁদুরটি ছটফট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মজিদ বাবার কাছে ইঁদুর কি খায় জানতে চাইলে কুদ্দুস জানায়- ‘যা পায় খায়। চিড়া, গুঁড়, মুড়ি, কাগজ, লোহা খায় না এমন জিনিস নাই’। গল্পে ইঁদুরের এই প্রসঙ্গটি এসেছে প্রতীকী অর্থে। এই প্রতীকের মর্মবাণী উদ্ধার হয়ে যায় পরমুহূর্তেই। আমরা দেখতে পাই, তিন সদস্যবিশিষ্ট যে পরিবারটি গল্প এখানে বলা হচ্ছে তারা আসলে প্রত্যেকে এক একটা ইঁদুর। সুতো আছে সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিদের হাতে। পরিবারটি সংসার পেতেছে স্যুয়ারেজ পাইপের ভেতর। সংসার চালায় কুদ্দুস মিয়ার বউ, মনোয়ারা। কুদ্দুসের একটা পা অবশ। ঘরে বসে থাকে। অথবা পায়ের দোহায় দিয়ে অলস বসে থাকে আর পরকালে সে যে সুখ পাবে এবং তার স্ত্রী নানা-কারণে সুখবঞ্চিত হবে সেসব কথা বলে। বাপ-ছেলে দুজনেরই ক্ষুধায় পেট জ্বলে। রাত নটার দিকে মনোয়ারা ফেরে, সাথে একটা অপরিচিত পুরুষ। কুদ্দুসকে ক্লান্ত কণ্ঠে মনোয়ারা বলে, ‘আপনে মজিদরে লইয়া একটু ঘুইরা আহেন। …মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মনোয়ারা। তার দিকে তাকিয়ে বড় মায়া লাগে কুদ্দুসের। মজিদের হাতে ধরা সুতার মাথায় ইঁদুর ঝুলতে থাকে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় সেই ইঁদুর বড় কাতর বোধ করে।’ এখানে এসে ইঁদুর আর এই অসহায় মানুষগুলি আলাদা থাকে না। অত্যন্ত কষ্টের এই গল্পটিও হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন সহজাত সরল ও তরল কণ্ঠে। স্যুয়ারেজের পাইপে থাকা নিয়ে কুদ্দুস বলে, ‘ও বউ, মনে হইতেছে কবরের ভিতর শুইয়া আছি। মানকের-নেকের আইসা সোয়াল-জোয়াব শুরু করব। মনোয়ারা জবাব দেয়নি। স্বামীর অধিকাংশ কথার সে কোনো জবাব দেয় না। এটা এক ধরনের বেয়াদবি। রোজ হাশরে মনোয়ারা এই বেয়াদবির কারণে বিপদে পড়বে। কুদ্দুস ঠিক করে রেখেছে সুযোগ-সুবিধা মতো বিষয়টা সে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলবে। সে রকম সুযোগ-সুবিধা হচ্ছে না।’ এখানে আমরা দেখতে পাই, লেখক কঠিন বাস্তবতাকে সিরিয়াস টনে না উপস্থাপন করে যতটা সম্ভব মূল গল্পের প্রতি অমনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই এই কাজটা করে থাকেন।

গল্পের আইরনি হল কুদ্দুস ইজ্জত সচেতন মানুষ। সে ভাবে রিকশা চালালে সকলে তুই তুই করে ডাকে, এতে সম্মান থাকে না। কিন্তু বেবিটেক্সিওয়ালাকে ডাকে আপনি বলে। ইজ্জতকে ছোট করে দেখতে চায় না কুদ্দুস। পরমুহূর্তেই আমরা দেখি সকাল থেকে উপোষ শরীর তার। বউ দুমুঠো ভাতের জন্য অন্য-পুরুষকে ঘরে এনেছে। এটাকে আমরা সিসুয়েশনাল আইরনি বলতে পারি। একইভাবে দেখি, মনোয়ারা যখন অন্য পুরুষকে নিয়ে বাড়ি ফেরে সজ্জাসঙ্গী হয়ে দুটো টাকা পাবে বলে, কুদ্দুস তখন ভাবে, ‘বেহেশতে তার একটা সুন্দর সংসার হবে এটা সেই ধরেই নিয়েছিল। মজিদ, শরিফা (মৃত মেয়ে) আর তার স্ত্রী মনোয়ারাকে নিয়ে অতি সুন্দর সংসার। …এখন মনে হচ্ছে বেহেশতের সেই সংসারে মনোয়ারার স্থান হবে না। রোজ হাশরে মনোয়ারা কঠিন বিপদে পড়বে। স্বামীর সুপারিশ সেদিন গ্রাহ্য হবে না, গ্রাহ্য হলে সে অবশ্যই বলত, আল্লাহপাক, এই মেয়ে তার সংসার বড় ভালোবাসে। সে যা করেছে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যই করেছে, স্বামী হয়ে আমি তাকে ক্ষমা করেছি। তুমিও তাকে ক্ষমা করে দাও।’ এখানে এসে হুমায়ূন আহমেদ ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে বাস্তবতা বা জীবনবোধের যে আইরনি সেটা তুলে ধরেছেন। গল্পটিকে আরও কয়েকটি স্তরে পাঠ করা যেতে পারে। বিশেষ করে নারীবাদী এবং পুঁজিবাদী সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করলে আরও অনেককিছু বের হয়ে আসবে।

‘কবি’ গল্পটিও বেদনার। নিঃসঙ্গতার। গল্পে কবি জোবেদ আলীর স্ত্রী গত হয়েছে। তার একান্ত সঙ্গী হল কবিতা এবং শিশুকন্যা। বর্ষণমুখর রাতে কবিতা লিখতে বসেছে। ওদিকে মেয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ডেকে উঠছে বাবা বলে। কবি শুনছেন কি শুনছেন না। এমন সুন্দর বৃষ্টিভেজা রাতে তার মন পড়ে আছে অন্যখানে। কবিতা লিখতে বসে একটি লাইনই ঘুরেফিরে আসছে- ‘কি সুন্দর বৃষ্টি আজ রাতে।’ গভীর আবেগে কবির চোখ ভিজে আসে।

হুমায়ূন আহমেদের গল্পে প্রতিপক্ষ নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি না। সরাসরি তিনি সমাজের অর্থব্যবস্থা বা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও দোষারোপ করেননি। তার চরিত্রের ভোগান্তির পেছনে সরাসরি কাউকেই তিনি দায়ী না করলেও আমাদের বুঝে নিতে সমস্যা হয় না, তিনি বৈষম্যমূলক সিস্টেমের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধ হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বেশ কটি ছোটগল্প তিনি লিখেছেন। গল্পগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এবং আগে-পরের নানা প্রেক্ষাপটে রচিত। এরপর মধ্যে সবচেয়ে পঠিত গল্প হল ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’। গল্পের বিষয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা। জলিল সাহেব দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা। মুক্তিযুদ্ধে যারা বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে তাদের বিচারের জন্য সরকার বরাবর পিটিশন করে তাতে জনসাধারণের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। পিটিশনের বিষয়বস্তু হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১০ লাখ ইহুদি হত্যার অপরাধে অপরাধীদের বিচার করা হয়েছে এবং এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ নৃশংসভাবে হত্যা করে অপরাধীরা কেমন করে পার পেয়ে গেল? তাদের বিচারের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন জলিল সাহেব।

‘শীত’ গল্পটি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সহায়হীন এক পরিবারের। বৃদ্ধ মতি মিয়া শীত ও ক্ষুধায় কাতর। ছেলে মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। পুত্রবধূ ফুলজান কোনোমতে সংসারটাকে চালিয়ে নিচ্ছে। বয়স অল্প তাই তাকে সহ্য করতে হচ্ছে অতিরিক্ত গঞ্জনাও। ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা গর্বিত এই উচ্চারণ করে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কম্বল নিয়ে আসে মতি মিয়া। কম্বল পেয়ে ‘ছেলের প্রতি গাঢ় কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে ওঠে’। ওদিক থেকে ফুলজানের কান্নার শব্দ আসে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা অপর একটি গল্প হল ‘পাপ’। যুদ্ধ-চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে এক স্কুল মাস্টারের অন্তঃসত্ত্বা বউয়ের কাছে আশ্রয় নেয় এক পাকসৈন্য। স্কুলমাস্টার জানতে পারে পরে। তাকে তার স্ত্রী অনুরোধ করে এই পাকিস্তানি সৈন্যকে কাছাকাছি কোনো মিলিটারি ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। যেহেতু মাস্টারের বউকে বহেনজি ডেকেছে এই কিশোর মিলিটারি এবং নিজের জীবনভিক্ষা চেয়েছে, তাই সে তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতে চায় না। তবে স্কুল মাস্টার আশ্রিত পাকিস্তানি সৈন্যটিকে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারে না। দেশের ঐ পরিস্থিতিতে একজন মিলিটারির জান বাঁচাতে যদি সে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত হয় এই ভয়ে। আবার তিনি দেশের শত্রুপক্ষেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশদ্রোহী হতে পারেন না, এই ভেবে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিরস্ত্র সৈন্যটিকে সে তুলে দেয়। কিন্তু বিবেক তাকে ছাড়ে না। এই পাপবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় আজন্ম। এটি মূলত যুদ্ধবিরোধী গল্প। গল্পকথক মাস্টারমশাই যে কারণে বলে- ‘যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়।’

হুমায়ূন আহমেদ-Humayun Ahmed‘উনিশ-শ একাত্তর’ গল্পটি যুদ্ধ চলাকালের। গাঁয়ের পাশ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল যাচ্ছে। সাথে এদেশি দোসররাও আছে। গাঁয়ের লোকজন লুকিয়ে পড়লেও বদি পাগলা সরল উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে যায়। তাকে বাঁচানোর জন্য ওদের সাথের একজন বাঙালি বলে, ‘লোকটা মনে হচ্ছে পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে পাগল থাকে।’ কিন্তু মেজর সাহেব তার কথা কানে তোলে না। তার নির্দেশে পাগলটাকে গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হল। গ্রামের ভিতু মানুষ হিসেবে পরিচিত আজীজ মাস্টারকে পাঠানো হয় বদি পাগলাকে ছাড়িয়ে আনতে। মেজর আজীজ মাস্টারের স্ত্রীর কথা জানতে চায়। সে বিয়ে করেনি শুনে তাকে বলে, ‘তাহলে চালাও কিভাবে? মাষ্টারবেট করো?’ এরপর জোর করে আজীজ মাস্টারের পায়জামা খোলা হয়। আজিজ মাস্টার একটা পর্যায়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কাপড় পরতে বললেও পরেন না, মেজর সাহেবের দিকে থুথু ছুঁড়ে মারেন। গল্পটা শেষ হয় এভাবে- ‘মেজর সাহেবের মুখ অসম্ভব বিবর্ণ। পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একজন নগ্ন মানুষ।’ এই গল্পে লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো, পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে থাকা বাঙালি রফিকউদ্দিক আজীজ মাস্টার এবং বদি পাগলকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। আমরা ধরেই নিতে পারি রফিকউদ্দিন রাজাকার। কিন্তু এখানে হুমায়ূন আহমেদ তার অন্য একটি দিক বড় করে তুলেছেন। এখানে তিনি রাজাকারদের সমষ্টিগত দেশদ্রোহিতার আদল উপস্থাপন না করে একজন ব্যক্তির মানবিক সম্ভাবনার গল্প বলেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার সময় তিনি ইতিহাসকে ইতিহাসের স্থানে রাখেননি। স্বাধীনতা-উত্তরকালের লেখক হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বয়ানে না গিয়ে, লিখেছেন ঘটনার সম্ভাব্যতা নিয়ে। আমরা জানি, ইতিহাসের পুনঃলেখন বা অনুলেখন সাহিত্যের কাজ না। ঐতিহাসিক ঘটনার নতুন নতুন মাত্রা আবিষ্কার করা আর প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনা করা আলাদা কথা। হুমায়ূন আহমেদ যে ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য রচনা করেছেন তার একটা ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে নিতে পারি নোবেলজয়ী কথাশিল্পী সালমান রুশদির কথায়, তিনি বলছেন, ‘পৃথিবীর একটা ব্যাপক অংশ (আমার) গল্পে চলে আসে। এর কারণ এই না যে আমি রাজনীতি নিয়ে লিখতে চাই। এর কারণ হল, আমি জনগণ নিয়ে লিখতে চাই। (তর্জমায়: বর্তমান আলোচক, প্যারিস রিভিউ) সমাজের প্রান্তিক জনজীবন হুমায়ূন আহমেদের গল্পের প্রধান বিষয় বলে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজ বাস্তবতার নানা অনুষঙ্গ চলে এসেছে। হুমায়ূন আহমেদ হয়ত মিলান কুন্দেরার মতো ইতিহাসের যতটা সম্ভব কম উপাদান নিয়ে সাহিত্য (উপন্যাস) রচনার পক্ষপাতী ছিলেন। ফলে তার সাহিত্যের যে ইতিহাস সেটি আর স্থির ইতিহাস হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও।

এ পর্যায়ে লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির সঙ্গে সাহিত্যিক উদ্দেশ্য কতখানি সেটি নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। চিনুয়া আচেবে বলেছেন, ‘প্রত্যেকে গল্প বোনে তার নিজের জন্যে, নিজের বেঁচে থাকাকে উপভোগ্য করে তুলতে। গল্পগুলো সত্য হোক মিথ্যা হোক, ভাল হোক মন্দ হোক, তার চোখ দিয়ে জগতকে দেখবার অসম্ভব এক শক্তি নিয়ে হাজির হয়।’ [‘দি ট্রুথ অব ফিকশন’ তর্জমায়: বর্তমান আলোচক] অর্থাৎ, সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কাজ হল গল্পটাকে নির্মাণ করা। তারপর আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। গল্পটা কেউ কেউ আবার লেখবার আগেই নির্মাণ করে ফেলেন। অর্থাৎ, তারা গল্পটাকে জেনে তারপর লেখেন। যেমন কার্লোস ফুয়েন্তেস বলছেন, ‘আমি কেবল কাঠামোর কঙ্কালটার কথা ভাবতে পারি। কীভাবে এগুবো জানি না।’ [প্যারিস রিভিউ, তর্জমায় আন্দালিব রাশদী] রবীন্দ্রনাথ ও তলস্তয়ের সাহিত্য এই শ্রেণির। তারা গল্পগুলো জানতেন। কাঠামোটা হয়ত লিখতে লিখতে ঠিক করে নিতেন। আবার অনেকে আছেন যারা গল্পগুলো জানেন না। যেমন জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি। তিনি বলছেন, ‘আমি অতো ভেবেচিন্তে লিখি না। আমি গল্পটার জন্যে অপেক্ষা করি। আমি জানতে চাই তাই লিখি।’ (তর্জমা: বর্তমান আলোচক, প্যারিস রিভিউ)

সাহিত্যের কাজ হল বায়বীয় একটা জগত তৈরি করা। সেই জগতের বাসিন্দারা বাস্তবের বাসিন্দাদের মতোই অমিত সম্ভাবনাময়ী। হুমায়ূন আহমেদের গল্পের সেই সম্ভাবনা দেখা যায়। তার চরিত্ররা সমাজের বাস্তবের চরিত্রদের হুবহু কপি-নির্মিতি না। যে কারণে তার চরিত্ররা প্রায়ই অদ্ভুত সব আচরণ করে। অস্বভাবী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের চিনে নিতে সমস্যা হয় না তার গল্পের চরিত্রদের।

হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখির মধ্য দিয়ে নিজের জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন। ফলে বিনোদনের উৎস হিসেবেও তার ছোটগল্পের আলাদা একটা কদর তৈরি হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা অনেক সময় মনের ব্যায়ামস্বরূপ কাজ করে। একইসঙ্গে বোধ ও বিনোদন বাংলাদেশের যে কজন ছোটগল্পকারের কাছ থেকে আমরা পাই তাদের মধ্যে নিশ্চিত করে হুমায়ূন আহমেদের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মপাসাঁ যে বলছেন: ‘The serious writer’s goal is not to tell us a story, to entertain or to move us, but to make us think and to make us understand the deep and hidden meaning of events.’ (‘The Writer’s Goal’) তা হুমায়ূন আহমেদের সমগ্র সৃষ্টির সঙ্গে না হলেও ছোটগল্পের সাথে দারুণভাবে যায়।

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View