মা শব্দটা মনে হলেই আমাদের বিপ্লবী ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কির কথা খুব মনে পড়ে। ম্যাক্সিম গোর্কির কালজয়ী অনবদ্য এক উপন্যাস ‘মা’। আমাদের মানসপটে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো এখনও ভীষণ জীবন্ত হয়ে আছে। শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে কালোত্তীর্ণ উপন্যাস ‘মা’ যেনো এখনও পরিবর্তনের হাতছানি দেয়। পৃথিবীর শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লড়াই-এও গোর্কির ‘মা’ অগ্রগণ্য এক হাতিয়ার। আর এ কারণেই যুগ যুগান্তর পেরিয়ে গেলেও এই উপন্যাসের গ্রহণযোগ্যতা অটুট রয়েছে আগের মতোই।
প্রাতিষ্ঠানিক অনেক জরিপেই পৃথিবীতে সবেচেয়ে বহুল পঠিত উপন্যাস বলে স্বীকৃত ‘মা’। আবার সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাসও এটি। ষাট-সত্তর-আশির দশকে এই উপন্যাসটি দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী তরুণদের কাছে শুধু পাঠ্য ছিল বললে ভুল হবে না, উপন্যাসের ভেতরের যে শক্তি তাও ধারণ করতো তরুণরা। সত্তর ও আশির দশকে আমরা যখন সমাজ পরিবর্তনের লড়াই-এ সোচ্চার তখন উপন্যাস ‘মা’ আমাদের বোধে-মননে-মগজে নিত্য সাহস সঞ্চার করতো। সে সময় আমার মতো অনেক বিপ্লবী তরুণের শিহরে, র্যাকে ‘মা’ উপন্যাস এক খন্ড মুগ্ধতা নিয়ে শোভা পেত। সময় বদলে বা পাল্টে গেলেও এই মহৎ উপন্যাসের গন্ধ-মাধুর্য এবং ভেতরের যে শক্তি তা যে পাল্টেনি, ফুরিয়েও যায়নি। তাই এখনও তরুণদের কাছে গোর্কির ‘মা’ ভীষণ জনপ্রিয়। পুঁজিবাদ আর কর্পোরেটরের এই দুর্দান্ত সময়েও ‘মা’ অস্পৃশ্য নয়, বরং সমাদৃত।
আজ ২৮ মার্চ, বিপ্লবী উপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কির জন্মদিন। তাকে স্মরণ করছি কৃতজ্ঞচিত্তে। ১৮৬৮ সালের এই দিনে তাঁর জন্ম। মধ্যরাশিয়ার ভলগা নদী তীরবর্তী নিঞ্জি নভগরদ এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। তবে একসময় তিনি নিজেই তাঁর নাম বদলে রাখেন ম্যাক্সিম গোর্কি। আর এ নামেই তিনি পৃথিবী বিখ্যত হয়ে উঠেন।
গোর্কি আজীবন ছিলেন লড়াকু। তার শৈশব-কৈশর, প্রোঢ় কোনো জীবনই কখনও স্বাচ্ছন্দময় ছিল না। অল্পবয়সে পিতৃমাতৃহীন হওয়াটা যেনো তাকে ফেলে দিয়েছিল অথৈ সাগরে। ১২ বছর বয়সে তাই দাদীমাকে খুঁজতে তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন। অবশ্য এর আগেই তার মা বিয়ে করে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করাটা তার জন্য ভীষণ জটিল হয়ে পড়েছিল। অভাব আর পারিবারিক বঞ্চনার কারণে তাই স্কুল ত্যাগ করে চলে যান। এরপর কয়েকবার আত্মহননের পথেও হেঁটেছিলেন তিনি। এখানে ওখানে চাকরি নেন। জুতার কারখানা থেকে জাহাজ-কতো না জায়গাতে কাজকর্ম করেছেন। আর এসব কারণেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হন। গোর্কি ছিলেন স্বশিক্ষিত এক তুখোড় লেখক।

তবে সব সামলে পরবর্তীতে ঘুরে বেড়ান রাশিয়ার এ প্রান্তর থেকে ও প্রান্তর। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯২ এই পাঁচবছর একটানা ঘুরে বেড়ান। পায়ে হেঁটে চলেন দীর্ঘপথ। কোথাও কোথাও কাজও করেন। আর এভাবেই সাধারণ মানুষের সাথে থেকে এক বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন সম্পর্কে বিবিধ ধারণাও লাভ করেন। বিশেষ করে মানুষের কঠোর সংগ্রাম সম্পর্কে একেবারে হাতেকলমে দীক্ষা নেন। মানুষের জীবন দেখতে দেখতেই লেখালেখিতে হাত দেন। ম্যাক্সিম গোর্কি ‘মাকার চুদ্রা’ নামে প্রথম একটা গল্প লেখেন। এই গল্পটি ১৮৯২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। এরপর আরও কিছু ছোট গল্প লিখলেন। গল্পগুলোতে জীবনের রুঢ় বাস্তবতা তুলে ধরলেন। বিশেষ করে সমাজের নিচুতলার মানুষের শোষণবঞ্চনাই হয়ে উঠলো তার গল্পের মূল উপজীব্য।
এরপর ১৯০০ সালে লিখে ফেললেন উপন্যাস ‘ফোমা গর্দয়েভ’। এটি ছিল তার লেখা প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ছাপা হওয়ার পর তিনি আলোচনার বেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯০১ সালে লিখলেন কবিতা ‘ঝড়ো পাখির গান’। সেসময় সেন্টপিটসবার্গে ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে প্রতিবাদ জানাতেই তিনি এই কবিতা লেখেন। এই কবিতা লেখার কারণেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশবাসী। শেষে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জার শাসক।
এদিকে দিন যতই যেতে থাকে ততই গোর্কি সাধারণ মানুষের পক্ষে সাম্যের কথা বলতে থাকেন। লেনিনের আদর্শের ছায়া প্রতিফলিত হতে থাকে তার সমস্ত কর্মকান্ডে। একসময় তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। বহুবিধ অথ্যাচার শুরু হয় তার উপর। একসময় তিনি আমেরিকাতে পাড়ি জমান। ১৯০৭ সালে তিনি রচনা করেন বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘মা’।
১৯৩৬ সালের ১৮ জুন গোর্কি মারা যান। মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন শয্যাশয়ী ছিলেন। তার মৃত্যুতে সমস্ত রাশিয়া যেনো শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মস্কো রেডিও থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়-‘মহান রাশিয়ান লেখক, শ্রমিকের বন্ধু, সাম্যবাদের চির সারথী ম্যাক্সিম গোর্কী চির বিদায় নিয়েছেন’। অনেকের মতেই ম্যাক্সিম গোর্কিই হলেন সেই লেখক যিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামকে চিত্রায়ন করেছিলেন। যিনি ছিলেন শোষিত, বঞ্চিত মানুষের পক্ষের এক অমোঘ শক্তি।
ম্যাক্সিম গোর্কির এই শুভ জন্মদিনে তাকে জানাই বিপ্লবী শুভেচ্ছা। তার লেখা আজও আমাদেরকে ভীষণ উদীপ্ত করে, নতুন করে ভাবতে শেখায়। সমাজকে বিনির্মাণ করতে হলে গোর্কীর ভাবনা ও লেখা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। চিন্তায়, মননে তাকে রাখতেই হবে।