
মিয়ানমারে বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র সংগঠন ‘পিপিলস ডিফেন্স ফোর্স’ (পিডিএফ) এবং দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী খণ্ডযুদ্ধের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নতুন এক পরিসংখ্যানে এমন দাবি করে বলা হয়েছে, এসব খণ্ডযুদ্ধ পুরো মিয়ানমারেই ছড়িয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের তরুণরা যখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করছে। তার ঠিক এক বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখল করে নেয়। এখন তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দিনে দিনে আরো সংগঠিতভাবে সামরিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আক্রমণের ধরণ ও ভয়াবহতায় ধারণা করা হচ্ছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এই সংঘাত বড় ধরনের গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে।
সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে সংঘাত পুরো মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়ছে। ‘আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন’ (অ্যাকলেড) এবং ‘ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট’ এর দেয়া তথ্য বলছে, সঙ্গবদ্ধ এসব বেসামরিক হামলা গ্রাম থেকে শহুরে কেন্দ্রগুলো থেকেও পরিচালিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শহরের মধ্যে থেকে এ রকম হামলা আগে চোখে পড়েনি।
অ্যাকলেড এর দেয়া তথ্য মতে, গত বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে এ পর্যন্ত দাঙ্গা-হামলায় মোট ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংঘাত ক্রমান্বয়ে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।


দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভ্যুত্থাবিরোধী বিক্ষোভ দমনে সেনা সদস্যদের অভিযানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ নাগরিক নিহত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেশী মারা যাচ্ছে বেসামরিক যোদ্ধারা। যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার প্রধান মিশেল ব্যাশেলে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাত গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
বিজ্ঞাপন
তিনি জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপর চাপ প্রয়োগ করতে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
মিশেল ব্যাশলে আরো বলেছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা তেমন জোরদার নয়। ছাড়া ছাড়া ভাবে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। এখন সেখানে সংঘাতময় পরিস্থিতি এমন রূপ নিচ্ছে যার কারণে দেশটির ভেতরে স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়েছে।
সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে লড়াই করা বিচ্ছিন্ন দলগুলোর সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম পিডিএফ এর বেশীরভাগ সদস্যই বয়সে যুবক। নিজেদের তৈরি অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তারা।

তাদেরই একজন হিরা (ছদ্মনাম) সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই জান্তা সরকারবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ঝাপিয়ে পড়েন।
সদ্য হাইস্কুল শেষ করা হিরা পিডিএফ প্লাটুনে যোগ দেয়ার পর তার উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছে। হিরা এখন মধ্য মিয়ানমারের এফডিএফ প্লাটুনের কমান্ডার। গতবছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ম্যা থয় থয় খাইং নামে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা হিরাকে এ লড়াইয়ে যোগ দিতে প্রভাবিত করেছে।
শুরুর দিকে মা-বাবা তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু হিরার তাগিদ দেখে পরে তারা মত পাল্টান। তারা হিরাকে বলেন, “তুমি যদি সত্যিই এ লড়াই চালিয়ে যেতে চাও তাহলে যুদ্ধ শেষ করে আসবে মাঝ পথে ফিরে আসবে না।”
মা-বাবার এমন উৎসাহ পেয়ে হিরা প্রশিক্ষণ শেষ করে এবং পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের মাঠে নেমে পড়ে।
সেনা অভ্যুত্থানের আগে হিরার মতো যুব সম্প্রদায় এক ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশে বড় হয়েছে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল তারা পছন্দ করেনি। এরা সীমান্তবর্তী আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যে আদিবাসীরা দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
মিয়ানমারজুড়েই ছোট ছোট দলে তরুণ যোদ্ধারা ছড়িয়ে আছে। এসব ছোট দলের নেতৃত্বে আছে আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর তরুণরা। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই প্রথম সামরিক শাষকের বিরুদ্ধে যুবকরা ঝাপিয়ে পড়েছে।

সাবেক ব্যবসায়ী নগর এখন মধ্য মিয়ানমারে পিডিএফ এর বেশ কয়েকটি ইউনিট পরিচালনা করেন। তিনি বলেছেন, এটা একটা অসম লড়াই। ব্যাপক অস্ত্রভান্ডারে সামৃদ্ধ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা লড়াইয়ে নেমেছে তারা নিজেদের বোমা নিজেরাই বানাচ্ছে। এই সামরিক বাহিনী চাইলেই রাশিয়া বা চীনের মতো সমর্থক দেশের কাছ আরো অস্ত্র জোগাড় করতে পারে।
সম্প্রতি জানা যায়, কয়েক সপ্তাহ আগে ইয়াঙ্গুনে রাশিয়া থেকে আনা অস্ত্রবাহী কিছু যান খালাস করা হয়েছে। অন্যদিকে পিডিএফ সদস্য স্থানীয়ভাবে সাধারণ মানুষের ভেতরে তাদের অবস্থান পোক্ত করছে। যার ফলে প্রান্তিক পর্যয়ে জান্তাবিরোধী অভিযান আরো সংগঠিত হচ্ছে।
‘দ্যা এক্সাইলড ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্নমেন্ট’ (এনইউজি) পিডিএফ এর কিছু ইউনিট গঠনে সহায়তা করেছে। তারা দুই পক্ষ নিয়মিতভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলেছে। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী পুলিশ স্টেশন এবং দুর্বল সামরিক স্থাপনাগুলোকে হামলার জন্য বেছে নিচ্ছে পিডিএফ। তারা কিছু অস্ত্রও দখল করেছে। নিজেদের তৈরি বোমা দিয়ে ব্যাংক এবং টেলিযোগাযোগ টাওয়ারের মতো স্থাপনায় হামলা করেছে।
ব্যবসায়ী নগর বলেছেন, দেশের ভবিষ্যতের ভার নিজেদের হাতে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তিনি মনে করেন, আলোচনার টেবিলে আর সমস্যা সমাধানের সুযোগ নেই। বিশ্ব সম্প্রদায় এ দেশটিকে অবজ্ঞা করে চলেছে। সে কারণে নিজেদেকেই শক্তিশালী করতে হবে।

হিরা এবং তার মতো যুব সম্প্রদায়ের লক্ষ্য সামরিক জান্তাকে উৎখাত করা। কারণ সামরিক বাহিনী নিরাপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। ঘরবাড়ী থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করেছে। তাদের সম্পদ লুঠ করেছে। মানুষকে ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এসব কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না, বলেছেন হিরা।
বিভিন্ন সময়ে গণহত্যা চালিয়ে এসেছে জান্তা সরকার। সে রকমই একটি অভিযানে বেঁচে যাওয়া একজন বলেছে, গত জুলাই মাসে একটি গণহত্যার ঘটনায় কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়। ডিসেম্বরে আরেকটি অভিযানে নারী ও শিশুসহ ৩৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কেউ গণমাধ্যমকে সাধারণত সাক্ষাৎকার না দিলেও বিবিসি অনলাইনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জান্তা মুখপাত্র জ মিন তুন পিডিএফ সদস্যদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ওই বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘তারা যদি আমাদের উপর হামলা করে তবে তার জবাব দিতে সেনা সদস্যদের নির্দেশ দেয়া আছে। মিয়ানমারকে নিরাপদ রাখতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ’
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং পিডিএফ এর সদস্য সংখ্যা ঠিক কত সেটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তিন লাখ ৭০ হাজার। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা কম হতে পারে। একইভাবে ডিডিএফ সদস্য সংখ্যা সঠিকভাবে বলা সম্ভব না।
বিজ্ঞাপন