মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা জাতিগত নিধনের শিকার হওয়ায় এর প্রতিবাদে বাংলাদেশে মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দূতাবাস ঘেরাওয়ের আগে সংগঠনের নেতারা বায়তুল মোকাররমের সামনে জড়ো হয়ে অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য রাখেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিধন বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারকে হুঁশিয়ার করেছেন তারা।
সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘যাদের মধ্যে মানবতা আছে তারা মিয়ানমারে নিষ্ঠুরতা সহ্য করবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিবেকও নাড়া দিয়েছে। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে তিনি আরও আরও কঠোর হবেন বলে আশা করছি।’
তবে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ বিতরণে কোন দুর্নীতি হলে ‘হাত ভেঙে দেয়া হবে’ বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন নেতারা।
নেতারা আরও বলেন, যেকোনভাবে ক্ষমতায় গেলেই মানুষের নেতা হওয়া যায় না। রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মিয়ানমারের নেত্রী সু চি তাই প্রমাণ করেছেন। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ বাংলাদেশসহ বিশ্ববিবেকে নাড়া দিলেও জাতিসংঘ এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি অভিযোগ করে অবিলম্বে রাখাইন প্রদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানান তারা।
প্রয়োজনে মিয়ানমার অভিমুখী লংমার্চ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের হয়ে প্রতিরোধ গড়বো।’
এসময় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানান চরমোনাই পীর। ইসলামি জোট ওআইসির ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘মুসলিমরা দুনিয়ার যেখানেই অত্যাচারিত হোক, ওআইসি তাদের পাশে দাঁড়াবে এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের রক্ষায় এই সংস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখছি না। তাহলে এই ওআইসি গঠনের তো কোন প্রয়োজনই ছিল না।’
বক্তব্য পর্ব শেষে সমাবেশ থেকে মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞে নিহত রোহিঙ্গাদের জন্য এবং চরম মানবিক সংকটের মুখে পড়া লাখ-লাখ রোহিঙ্গার জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
সমাবেশ শেষে বেলা পৌনে ১২ টায় বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল করে মিয়ানমার দূতাবাস অভিমুখে যাত্রা শুরু করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। মিছিলের অগ্রভাগে মিয়ানমানমারের নেত্রী অং সান সুচির ছবিতে জুতার মালা দেয়া হয় এবং পুড়িয়ে দেয়া হয় মিয়ানমারের পতাকা। পল্টন মোড় হয়ে বিজয়নগর, কাকড়াইল হয়ে শান্তিনগর মোড়ে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে শেষ হয়। এখানেই চরমোনাই পীর মিছিলটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন। একটু পরেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব এটিএম হেমায়েতউদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল স্মারকিলিপি জমা দিতে মিয়ানমার দূতাবাসে যায়।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৪শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।