অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে দালালদের খপ্পরে পরে গত তিন বছরে সিরাজগঞ্জের তিন শতাধিক যুবক নিখোঁজ হয়েছে। দালালদের হাতে আরো টাকা দিয়েও প্রিয়জনের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা।
এরকম একজন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের রুপনাই গ্রামের শাহ আলম। ছয় মাস আগে পরিবারের অভাব ঘোঁচাতে সমুদ্র পথে ট্রলারে চেপেছিলেনন তিনি। ছয় মাসে আলমের পরিবারের অভাবতো ঘোঁচেইনি, বরং তাকে ঘিরে নানা আশংকায় দিন কাটাচ্ছে পরিবার।
শাহ আলমের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘অনেক ঋণ হইছে, ট্রলারে বিদেশ যাও। আমার ছেলে তাদের কথা শুইনা গেছে। বাপ-মা, বউ, পুলাপাইন কেউ জানে নাই। বছর পার হয়ে যায় ট্রলার ছাড়ে না। পরে বলে স্টোক কইরা বেটা মারা গছে। আমি মনে করি বেটা মরে নাইকা। সরকারের কাছে আমার ছেলেরে আমি বুকের কাছে জীবিত চাই।’
হাকিম, রওশন নামের দুইজনের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে আলমের ভাই জানান, তার ভাইকে নেওয়ার সাতদিন পরে তাদের কাছে এসে দুইলাখ বিশ হাজার টাকা চেয়েছে। তবে ভাইয়ের সাথে কথা না বলে টাকা দিতে রাজি হননি বলে শেষ পর্যন্ত কথা বলা হয়নি তার।
পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘থানাতে আমরা গিয়ে মামালা করলাম। কিন্তু থানা থেকে কোনো সাড়া দেয় না।’
শুধু শাহ আলমই নন, গত তিন বছরের বিভিন্ন সময় ইসমাইল, শহীদুল, আলমগীর ও ইয়ামিনসহ জেলার প্রায় তিনশ’র বেশি যুবক কম খরচে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া রওনা দেন। এরপর তাদের আর খোঁজ মেলেনি।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের উপকূলীয় জঙ্গলে গণকবর পাওয়া আর মোবাইল ফোনে মুক্তিপণ চাওয়ার ঘটনায় এসব পরিবারে উৎকন্ঠা বেড়েছে।
ভুক্তভোগী একজনের মা তার ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নয় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি জানান, কয়েক মাস হলো তার ছেলের কোনো খবর পাচ্ছেন না। এখন যেভাবেই হোক ছেলেকে ফেরত চান তিনি।
এলাকার একজন নেতৃস্থানীয় রফিকুল ইসলাম জানান, তাদের এলাকার মানুষ সব সরল সোজা মানুষ। কিছু অসৎ লোক বিদেশে নেওয়ার কথা বলে অনেক মায়ের বুক খালি করছে। অনেকে মারা গেছে।
তবে কেউ কেউ বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকেই টাকা পয়সাও পাঠায়। আমাদের এলাকার যে চারটা ছেলে গেছে খুবই দরিদ্র। ৩৫-৪০ দিন হয়ে গেলো তাদের কোন খোঁজ খবর আমরা পাচ্ছি না। খালি শুনি যে ট্রলারে গেছে।
দালালদের শাস্তি দাবি করে রফিকুল বলেন, মানুষ যেনো এভাবে ট্রলারে বিদেশে না যায়, যারা ট্রলারে মানুষ পাচার করে ওইসব দালালদের যেনো সরকার শাস্তির ব্যবস্থা করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন এই ব্যাপারে তৎপর হোক।
স্থানীয়রা বলছেন, জেলার সরকারি কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে বিদেশগামী এসব মানুষের কোন তালিকা নেই।
সিরাজগঞ্জ জেলার ডিডিপি’র নির্বাহী পরিচালক কাজী সোহেল রানা বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজ করি। নভেম্বর মাসে আমাদের গবেষণায় বলেছিলাম চার শতাধিক মানুষ নিখোঁজ আছে। পরবর্তীতে মাঠে গিয়ে দেখেছি কিছু কিছু মানুষ ফেরত এসেছে। কিছু কিছু মানুষের পরিবারের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে এখনো মনে হচ্ছে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ নিখোঁজ।
মানবপাচার রোধে নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ না নিলেও অভিযোগের ভিত্তিতে দালালদের গ্রেফতার ও জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
বেলকুচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, মানবপাচারের ব্যাপারে বেশ জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই এলাকা থেকে অনেক মানুষ পাচার হয়েছে। এরা ট্রলারে করে মালয়েশিয়া গেছে।
তিনি আরো জানান, আমরা বিষয়ে ৩ টি মামলায় মানবপাচারকারী চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিখোঁজদের ব্যাপারেও খোঁজ নিচ্ছেন তারা।
সর্বস্ব হারানো স্বজনেরা এখন টাকা চান না, চান শুধু প্রিয়জনকে ফিরে পেতে। যে দালালরা মানুষকে পণ্য বানিয়ে বিদেশে পাচার করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করেছেন নিখোঁজদের স্বজনরা।