
অর্থবিত্তের মোহে কারখানা তৈরি করা শিল্পদ্যোক্তাদের কাছে শ্রমিকরা দাসত্ব বরণ করছেন বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিক নেতারা। তবে এসব অভিযোগ মানতে রাজী নয় মালিক পক্ষ।
শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রতিনিয়তই মালিকদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য অধিকার থেকে। আর মালিকপক্ষ বলছেন, শ্রমিকরা মালিক ও কারখানার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শ্রমিকদের জন্য কতটা আন্তরিক তা পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র না থাকলেও শিল্পদ্যোক্তাদের নেয়া কিছু উদ্যোগ বিশ্লেষণ করলে তা সহজেই বোঝা যাবে।

মালিকপক্ষ কখনই শ্রমিকদের সাথে ভাল আচরণ করেনি অভিযোগ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি ২২ বছর ধরে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশের কারখানার মালিকরা কখনই শ্রমিকদের সঙ্গে শিল্পসুলভ আচরণ করেনি। কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিকদের চড়-থাপ্পড় মারছেন-এ ধরনের খবরও প্রায় পেয়ে থাকি। তারা শ্রমিকদের আপন ভাবতে পারছে না।

মালিকরা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকার রাখার উদ্দেশ্যে নয়, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার মোহ নিয়েই শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরোক্ষভাবে শ্রমিকরা অর্থনীতিতে অবদান রাখছে-এ ধরনের বাস্তবতা কখনই তারা স্বীকার করে না। মালিকপক্ষ মনে করে শ্রমিকরা তাদের দাস। যখন যা বলবে তা মেনে নিয়েই দাসত্ব বরণ করতে হবে। অর্থবিত্তের মালিক হওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

শ্রমিকদের আপন করে নেয়া কল্পনাপ্রসূত উল্লেখ করে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার চ্যানেল আই অনলাইনেক বলেন, শ্রমিকদের আপন করে নেয়ার মনমানসিকতা কবে নাগাদ বাংলাদেশের কারখানার মালিকদের মধ্যে তৈরি হবে, তা নিয়েই ভাবছি আমরা। এটি এখনও কল্পনায়। তবে শ্রমিকরা যাতে নিরাপদভাবে কারখানায় কাজ করে যেতে পারে এবং মানসম্মত ভাবে যেন খেয়ে-দেয়ে জীবন বাঁচাতে পারে সেরকম বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার ও ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাজপথে নামতে পারবে। এটা তাদের অধিকার। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক। এ সময় মালিক-শ্রমিক একত্রিত হয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা খুবই জরুরী। এই মূহূর্তে আমরা চাই মালিক-শ্রমিক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাক।
বর্তমানে শিল্প-কারখানায় কর্মপরিবেশ শতভাগ উন্নত হলেও শ্রমিকদের অধিকার এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি বলে মনে করেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনেক বলেন, কারখানার মান শতভাগ উন্ন হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মালিকদের সাথে শ্রমিকদের সম্পর্ক আগের মতোই তিক্ত রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি আরো বদলাতে হবে। শ্রমিকদের সংগঠন করার আইন ও অধিকার থাকলেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। মালিকদের অবহেলায় তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে মালিকদের অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পেছনে শ্রমিকদের অবদান স্মরন রাখলেই সব সমস্যার সমাধান সহজ হবে জানান তিনি।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। দেশের শ্রমিকদের সিংহভাগই জড়িত পোশাক তৈরির কাজে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসেব মতে, ৪৪ লাখের বেশি শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহ হয় এ খাত থেকে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, শ্রমিকরা কারখানা ও মালিকদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাদের প্রতি কতটা আন্তরিক তা পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র নাই। তবে তাদের স্বার্থ রক্ষায় গত কয়েক বছরে বহু উন্নয়ন হয়েছে। এর মধ্যে দুই-তিনটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই যাতে সহজেই বুঝা যাবে শ্রমিকদের উন্নয়নে আমরা কতটা আন্তরিক।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে যখন ভয়াবহ রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে তখন বাংলাদেশে মাত্র ৮০টি ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯১-তে। গত তিন বছরেও বিভিন্ন কারখানায় বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করায় মাত্র তিন জনের প্রাণহানী ঘটেছে।
এছাড়া বিদেশি ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তথ্যমতে, ৮০ শতাংশ কারখানায় রিমেডিয়েশন করা হয়েছে।
সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্রমিক-কল্যাণ ফান্ডে বছরে ৮০ কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়। এই টাকা দিয়ে তাদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, শিক্ষার ব্যবস্থা করা, তাদের সন্তানদের আর্থিক সুবিধা প্রদানসহ সব ধরনের কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। এসব কিছু বিবেচনা করলেই শ্রমিকদের প্রতি মালিকরা কতটা আন্তরিক তা সহজেই অনুমেয় বলে জানান তিনি।