বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি আমরা। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে দেশের অর্জনগুলো সামনে তুলে আনছি আমরা। হিসেব করছি কোথা থেকে কোথায় এসেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর যে দেশটির টিকে থাকা সম্পর্কে বিশ্বের অনেক চিন্তক নানা সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, সেই দেশটিই আজ উন্নয়নের এক রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সন্দেহ নেই এই গর্বিত জায়গায় পৌঁছানোর পেছনে বহু মানুষের ত্যাগ, শ্রম ও নিষ্ঠা রয়েছে, রয়েছে নিরন্তর কর্মসাধনা। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর সরকারি পরিকল্পনাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, ঘটেছে রাজনৈতিক পালাবদল। একেক সরকার এসে একেকভাবে দেশ গোছানোর চেষ্টা করেছে। শুরুর দিকে যে মানুষগুলো সরকারের পাশাপাশি উন্নয়নের এক গভীর চিন্তা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন, তাদের মধ্যে অন্যতম স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর স্বপ্নের সংগঠন ‘ব্র্যাক’ বাংলাদেশের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠেছে।
ব্র্যাকও উদযাপন করছে পথচলার সুবর্ণজয়ন্তী। রাজনীতি ও দলমতের ঊর্র্ধ্বে থেকে ব্র্যাক ভেতরে ভেতরে অনন্য সাধারণ সব কাজ করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে ব্র্যাকের রয়েছে অসামান্য কর্মযজ্ঞ। এই উদ্যোগগুলোর সাফল্যই ব্র্যাককে পৃথিবীর সবচাইতে বড় সংগঠনে পরিণত করেছে।
অন্তত ত্রিশ বছর আগের কথা। দিনাজপুরের মাধবদি চিড়াকুঠিপাড়ায় খুব ভোরে গেছি চিত্রধারণ করতে। একে তো শীতের দিন তার ওপর ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। গ্রামে ঢুকতেই কানে এলো একঝাঁক শিশুর পড়াশোনার কলরব। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম এক কক্ষের একটি মাটির ঘরে শিশুরা পড়ছে। যেখানে মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পায় না, সেখানে প্রতিটি ঘরের শিশু স্কুলে যাচ্ছে! সেটি ছিল ব্র্যাকের উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের স্কুল। যেখানে একজন শিক্ষক ৩০ জন করে শিশুর সব বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সেটি ছিল এক বৈপ্লবিক শিক্ষা বিকাশের পদ্ধতি। তৃণমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা নানা কারণে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেন না, তাদের জন্য এই শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের সাক্ষরতার হার বাড়াতে রেখেছে অসামান্য অবদান। কাজগুলো এখনও চলছে।

আমি টানা চার দশকেরও বেশি সময় ব্র্যাকের কাজের প্রতিফলনগুলো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে যেতে দেখছি। গ্রামে কাজ করতে গেলে একদম প্রত্যন্ত পল্লীতে হঠাৎ অন্য ধরনের ভবন কাঠামো দেখে উন্নয়নের আভাস পেয়েছি। চারদিকে খড়ের ছাউনি মাটির ঘর, দুয়েকটি টিনের চালা বাঁশের বেড়ার ঘর, তার মধ্যে একটি পাকা ভবন। কাছে গিয়ে দেখেছি সেটি ব্র্যাকের ভবন। উপলব্ধি করেছি এসব উন্নয়নেরই এক ভিন্নরকম সূচনা।
আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবি এজন্য যে, আমার কাজের ভেতর দিয়েই চোখের সামনে দেশের কয়েকটি উন্নয়ন সংগঠনের ব্যাপক কার্যক্রম দেখার সুযোগ পেয়েছি। এসব কাজের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগসূত্র না থাকলেও আমরা একইসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। একপর্যায়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। সেটা আশির দশকের শেষের দিকে হবে। যতদূর মনে পড়ে, সেসময় শিক্ষা নিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে কাজ করছেন। তার উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ছে দেশব্যাপী। ক্ষুদ্রঋণ থেকে দিনে দিনে গ্রামীণ স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, কৃষি ইত্যাদি কাজগুলোও সম্প্রসারিত হচ্ছে। গ্রামীণ তৃণমূল কৃষক পরিবার অল্পস্বল্প পুঁজি হাতে নিয়ে বর্গাচাষের যে সুযোগ পায়, তার পেছনে ছিল ব্র্যাকের মতো সংগঠনগুলো। গ্রামে গ্রামে আমি দেখেছি কৃষক ভূমিহীন হওয়ার কারণে সরকারি ব্যাংকের ঋণ পায় না। পুঁজি না থাকার কারণে জমিও আবাদ করতে পারে না। আবার মহাজনি ঋণের সুদ নিয়ে পুষিয়ে উঠতে পারে না। তখন এনজিও-র ঋণ তাদের ভীষণভাবে কাজে লেগেছে। চাষীর বউ ঋণ এনে দিয়েছে, তার ওপর ভরসা করে সে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছে। কিছু বিফলতা, ব্যর্থতা বা নেতিবাচক উদাহরণ নেই, তা নয়। তবে তৃণমূলে উন্নয়নের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই কাজগুলো ছিল অনেক বেশী কার্যকর। আমি মনে করি, এর পেছনে স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো মানুষের দীর্ঘ এক মিশন ও ভিশন কাজ করেছে।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে সিলেটের শাল্লায় যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে বসবাসরত মানুষের পাশে ব্র্যাকের জন্ম হয়। শুরুতে সংগঠনটি ছিল ত্রাণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্রিক, পরে ১৯৭৩ সালে এসে এটি সার্বিক গ্রামোন্নয়নমুখী একটি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারপারসন। এ থেকে আরেকটি জিনিস বোঝা যায়, ব্র্যাকের বেড়ে ওঠার সঙ্গে আমার জাতীয়তা, সংস্কৃতি, মুক্তবুদ্ধি ও উন্নয়নের এক গভীর সংমিশ্রণ রয়েছে।
দেশে-বিদেশে ব্র্যাকের কাজ আজ সারাবিশ্বে সমাদৃত। পৃথিবীর সবচাইতে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন বাংলাদেশের ব্র্যাক দেশের বাইরেও আমাদেরকে গর্বিত করে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে ব্র্যাক। আমার সুযোগ হয়েছে পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় ব্র্যাকের কাজ সরেজমিনে দেখার। বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি উন্নয়নে ব্র্যাকের কাজ সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। ব্র্যাক বাংলাদেশভিত্তিক একটি উন্নয়ন সংগঠন হলেও আফ্রিকার দেশটির উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অগ্রগতির সঙ্গে এখন মিশে গেছে গভীরভাবে। সেখানে এখন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্র্যাককে ধরা হয় সবচাইতে কার্যকর ও গতিশীল অংশীদার হিসেবে। আমি উগান্ডার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কৃষি প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি থেকে শুরু করে তৃণমূলের অনেক কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই ব্র্যাকের উন্নয়ন তৎপরতার প্রশংসা করেছেন। আমি দেখেছি, স্যার ফজলে হাসান আবেদের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েপড়া উন্নয়নচিন্তা এখন পৃথিবীর অনেক মানুষকেই প্রভাবিত ও আলোড়িত করছে। বরাবরই দেখেছি শত ব্যস্ততার ভেতর আমাদের যেকোনো উদ্যোগে, চিন্তায় ও আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়েছেন, এসেছেন ও মুগ্ধ করে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ব্র্যাক, বাতির গোড়ায় কোনো অন্ধকার রাখেনি। বলতে চাই, দেশের তৃণমূল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যেন্নয়নে ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ব্র্যাক রাষ্ট্রের এক অসাধারণ উন্নয়ন অংশীদার। আমি মূল্যায়ন করি ব্র্যাকের সেই কাজগুলো, যখন দেখি গ্রামের একজন প্রাান্তিক কৃষকের মাটির ঘরের ভেতর বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে, তার ঘরেও রয়েছে ফ্রিজ, টিভি। সংসারের এই উপকরণগুলো কেনার জন্য যে টাকার প্রয়োজন, সেই টাকা জমানো একসময় প্রান্তিক কৃষকের জন্য ছিল অসম্ভব। তার স্ত্রী ব্র্যাক বা ব্র্যাকের মতো সংগঠনে যুক্ত থেকে এককালীন ঋণ নিয়ে পরিবারের এই স্বপ্নগুলো পূরণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ওই ঘরের নারী সদস্যটি সংসারে ক্ষমতায়িত হয়েছেন। এভাবে আজ বাংলাদেশের যতগুলো উন্নয়ন মাপকাঠি সারা পৃথিবীতে বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তার অনেকগুলোর সঙ্গেই ব্র্যাকের সম্পৃক্ততা রয়েছে, অবদান রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়, এক্ষেত্রেও রয়েছে ব্র্যাকের অনন্য অবদান। ব্র্যাকের স্বপ্নদ্রষ্টা স্যার ফজলে হাসান আবেদ শারীরিকভাবে আজ নেই। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন ব্র্যাকের সাফল্যের অভিযাত্রার ভেতর। রয়ে গেছেন ব্র্যাকের বিরামহীন কর্মপদ্ধতির ভেতর।