সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল। বিসিএসে সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে পরীক্ষার্থী অনেকেই সুখ-দুঃখ-হতাশা প্রকাশ করছেন। এমনকি এই পরীক্ষায় সাফল্য-ব্যর্থতাকে তারা জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা বলে ভেবে নিচ্ছেন।
বিসিএস পরীক্ষা এবং পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ। স্মৃতিচারণমূলক সেই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন:
‘আমিও জীবনে দুইবার বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম। ফলাফল প্রিলিমিনারিতেই ফেল। যারা আমাকে চেনেন, তারা জানেন আমি ছিলাম ওয়ার্কিং স্টুডেন্ট। সকালে হল থেকে বের হতাম। ক্লাস, কাজ, আড্ডা শেষ করে হলে আসতে আসতে রাত ২/৩ টা। আবার সকালে উঠে নাস্তা করে/না করে বের হয়ে যাওয়া। একদিকে বিভাগের ছাত্রত্ব ধরে রাখা, অন্যদিকে ঢাকায় বাঁচার খরচ ম্যানেজ করা। ফলে আমার জীবন এক অর্থে ছিল অসাধারণ (সাধারণ নয় অর্থে)। কাজ করতে করতে ছাত্রজীবনে (তখনো মাস্টার্স এর রেজাল্ট হয়নি) ২০০৭ সালেই আমার বেতন হয়ে গিয়েছিল প্রায় ২০,০০০ টাকা। ছাত্রজীবনেই আমি আওয়ামী লীগ বিটের পরিচিত রিপোর্টার। তারপর তো ইতিহাস।
২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসল। আমি সবচেয়ে কম বয়সে ঐসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র প্রেস উইং এর মেম্বার হয়ে গেলাম। লাইফস্টাইলই চেঞ্জ হয়ে গেল আমার। একবার কোন এক বছরের ১২ মাসে আমি ৬ টা দেশে গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। হজ্ব করা থেকে শুরু করে ইউএসএ, রাশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সবগুলো উন্নত দেশে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভ্রমণ করেছি, কাজ করে দল, অফিস ও রাষ্ট্রকে সেবা দিয়েছি।
আবার খুব ব্যক্তিগত কারণে ‘সাংবাদিকতা’ ছেড়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছি। আমার জীবনে কাজ সংক্রান্ত কোন হতাশা ছিল না। এর বড় কারণ বোধ হয় আমার কাজকে আমি ভালবাসতাম, এনজয় করতাম। বিসিএস দিয়েছিলাম মূলত পারিপার্শ্বিক একটি চাপে পড়ে। আবার প্রিলিতেই ফেইল করেছি, তাতেও আমার হতাশা ছিল না। আমার পরিবারও চাইত আমি ‘ফ্রি’ থাকি।
দুইবার বিসিএসে প্রিলিতেই বাদ পড়ে যাওয়ার পেছনে দুইটা কারণ ছিল (১) অংকের দক্ষতা আমার কখনোই ছিল না, (২) ছাত্রজীবনে/পরে কাজের চাপে প্রস্তুতি নেয়ার যথেষ্ট সময় ছিল না। কিন্তু আমার হতাশা ছিল না। আজ যখন ছাত্রছাত্রীদের মনে হতাশা দেখি, বিসিএস না হলে সব শেষ হয়ে গেল বলে হাহাকার দেখি, তখন আমি বিরক্ত হই। বিসিএস, বিশেষ করে প্রশাসন, পুলিশ এবং ফরেন ক্যাডার নিয়ে আমার সকলের মনে যে বিশাল প্রত্যাশার বেলুন এবং শেষ পর্যন্ত ক্যাডার না হওয়ার দরুন অনেকের মনে যে হতাশা দেখি, হাহাকার দেখি, অশান্তি, অস্বস্তি দেখি তার জন্য আমাদের এই সমাজ এবং রাষ্ট্রকেই আমি দায়ী করি।
একদিকে সমাজে একমাত্র পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেটদেরকেই ক্ষমতার ধারক মনে করা হয়, অন্যদিকে রাষ্ট্র নিজেই আবার বিরাট বৈষম্যের সিস্টেম তৈরি করে রেখেছে। সমস্ত সুযোগ সুবিধা যেন সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য। একজন সরকারি ডাক্তার বেতন ছাড়া রাষ্ট্র থেকে কিছুই পায় না, এমনকি প্রমোশনও না। তার জন্য কোনো স্টাফ নেই, ট্রান্সপোর্ট নেই। অন্যদিকে মাঝারি মানের মেধাবীরা এদেশে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ হয়ে জেলা/উপজেলা পর্যায়ে পোস্টিং পেয়ে, গাড়ি পেয়ে, কর্মচারীর বহর পেয়ে নিজেকে ঈশ্বর জ্ঞান করে। ডাক্তারদের পোস্টিং হয় এমন সব স্থানে যেখানে একমাত্র হেলিকপ্টার দিয়ে গিয়ে প্যারাসুট দিয়ে নেমে অফিস করা যাবে। গ্যাস নাই, পানি নাই, বিদ্যুৎ নাই, কথা বলার মানুষ নাই।
যাইহোক, মূল কথায় আসি। বিসিএস ছাড়া বাকি যেসব কাজ তার কি কোনো দাম আমরা দেব না? এদেশের কৃষক, শিক্ষক, ডাক্তার, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, বেসরকারি চাকুরীজীবী সবাই যেদিন নিজের কাজকে ভালবাসবে, রাষ্ট্র যেদিন সবার কাজের মর্যাদা দিবে, সমান সুযোগ সুবিধা দেবে, যেদিন সমাজ সব কাজকে মর্যাদা দিতে শিখবে সেদিনই বোধহয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সুগম হবে। তার আগে নয়।’