মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। যার শুরুটা উরুগুয়ে বিশ্বকাপ ১৯৩০ দিয়ে-
ছোট স্ফুলিঙ্গ থেকে জন্ম নিতে পারে গগনভস্ম করা দাবানল। পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে সর্বস্ব। সেই ছাই থেকেও আবার ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠতে পারে কোনো সম্ভাবনা। মানব ইতিহাসে এমন নজির নেহাত কম নয়। ক্রীড়াক্ষেত্রেও দেখা মেলে স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়া সম্ভাবনার। ক্রীড়া-ইতিহাসের পাতায় জমে থাকা ছাইভস্ম সরালে সবচেয়ে বড় যে নজিরটি সামনে আসবে, সেটি ফুটবল বিশ্বকাপ। জনপ্রিয়তার পারদে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া যে বিশ্বযজ্ঞের জন্ম হয়েছিল তখনকার অলিম্পিক কমিটির ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করা এক সিদ্ধান্তে।
ফুটবল খেলাটা তখন চলছিল বিচ্ছিন্নভাবে। একটা আন্তর্জাতিক যৌথ-আবহ দেয়ার চেষ্টার বড় অভাব। হবেই না বা কেন! আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছু করতে হলে তো স্বীকৃতির একটা ব্যাপার থাকা লাগে, লাগে জোটবদ্ধ হওয়ার মতো কোনো সংস্থাও। ১৯০৪ সালে সেটাই ঘটে ফিফার জন্মের মধ্য দিয়ে। তার বহু আগেই অবশ্য প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলা হয়ে গেছে। গ্লাসগোতে ১৮৭২ সালে, ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড মুখোমুখি হয় প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের। গোলশূন্য ড্রয়ে যার সমাপ্তি।
পরে অনেকটা সময় পেরিয়ে ফিফা এল। সংস্থাটি শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা ধরে এগিয়েছে। ১৯০৬ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা করে ব্যর্থও হয় সংস্থাটি। এরপর ধীরে চলার নীতি নেয়। এর মাঝেই ১৯০৮ সালে লন্ডনে হওয়া গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ফুটবল অফিসিয়াল প্রতিযোগিতার মর্যাদা পায়। কিন্তু নিয়ম করা হয় অংশ নিতে পারবে কেবল দেশগুলোর অ্যামেচার দল। ১৯১২তে স্টকহোম অলিম্পিকেও তাই।
১৯১৪ সালে ফিফা আগ্রহী হয় অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে মিলে ‘ওয়ার্ল্ড ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ফর অ্যামেচার’ নামে অংশগ্রহণ এগিয়ে নিতে। ১৯২০ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে মিশর (তখনকার ইজিপ্ট) ও ১৩টি ইউরোপিয়ান দেশ অংশ নেয়, জয়ী বেলজিয়াম। ফিফা অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে থাকে। ১৯২৪ ও ১৯২৮ অলিম্পিকে উরুগুয়ে চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলের কাজ এগিয়ে চললেও কেবল অ্যামেচার দলের অংশ নেয়ার বিষয়টিতে ধীরে ধীরে বিরক্ত হয়ে ওঠে ফিফা। অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসে।
সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। উল্টো ফুটবলের একমাত্র বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট ঘিরে নেমে আসতে থাকে শঙ্কার ছায়া। ১৯৩২ অলিম্পিকে ফুটবলকে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। তাতে ক্ষুব্ধ হয় ফিফা। একদিকে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকা, অন্যদিকে অলিম্পিক কমিটির পিছু হটার সিদ্ধান্ত, ফুটবলের অভিভাবক ফিফাকে ভাবায়। সিদ্ধান্তটি শেষপর্যন্ত স্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয় ফুটবলের একটি আলাদা ও একক বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টায় থাকা ফিফার অভ্যন্তরে। ফল, ১৯২৮ সালের ২৮মে ফিফা কংগ্রেস আমস্টারডামে সিদ্ধান্ত নেয় নিজেদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের। সিদ্ধান্ত হয় ১৯৩০ বিশ্বকাপ আয়োজনের।
আয়োজন সিদ্ধান্ত তো হল, কিন্তু মহাযজ্ঞ বসবে কোথায়? খেলবেই বা কারা? কোন প্রক্রিয়ায়? সেসব নিয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। আয়োজক হতে আবেদন করেছিল পাঁচটি দেশ- সুইডেন, হল্যান্ড, ইতালি, স্পেন এবং উরুগুয়ে। ফিফা বেছে নেয় তালিকার শেষ নামটিই। ১৯২৪ এবং ১৯২৮ অলিম্পিকজয়ী দলটি এমনিতেই ফুটবল বাজার গরম করে রেখেছিল, উত্তাপের সুযোগটা নিতে সম্মত হয় ফিফা। অন্য একটি কারণও ছিল, উরুগুয়ের স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তির জমকালো উদযাপনে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল যুক্ত হওয়ার রোমাঞ্চ।
উরুগুয়ে সবুজ সংকেত পেয়ে কিছু বাড়তি প্রস্তাবও করে ফিফায়। ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য নতুন একটি স্টেডিয়াম বানানোর পাশাপাশি টুর্নামেন্টে আসা দলগুলোর ভ্রমণ ও অন্যান্য খরচের পুরোটাই ফেরত দেয়ার প্রস্তাব ছিল তাদের। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে উরুগুয়ে জোরেশোরে মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিশ্বকাপ ট্রফির আদল কেমন হবে সেটি ঠিক করতে ফ্রেঞ্চ স্থপতি অ্যাবেল ল্যাফলোর দ্বারস্থ হয় ফিফা।
আয়োজক পাওয়ার পর অংশ নেয়া দেশের তালিকা করায় মন দেয় সংস্থাটি। আমন্ত্রণ জানানো হয় ফিফার প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকেই। ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ ছিল তাই বাছাইপর্বহীন। ফিফার আমন্ত্রণে দ্রুত সাড়া দেয় লাতিন অঞ্চলের দেশগুলোই। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পেরু- এই ছয় দেশ সম্মতি জানায়। নর্থ আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকো সম্মতি দেয়। কিন্তু ফুটবলের বড় আরেকটা শক্তি ইউরোপ-অঞ্চল থাকে নির্লিপ্ত।
ইউরোপের দেশগুলো দল না পাঠানোর পেছনে কারণ দেখায় অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে। ইউরোপে তখন চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের যুগ। লাতিন আমেরিকায় ভ্রমণ ছিল ব্যয়বহুল আর দীর্ঘ ক্লান্তির। ইউরোপ থেকে তাই কোনো দেশই আগ্রহ দেখায়নি শুরুতে। পরে অবশ্য ফিফা প্রধান জুলে রিমের বিশেষ অনুরোধে চারটি দেশ অংশ নিতে সম্মতি জানায়। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়াকে নিয়ে তাতে পূর্ণ হয় বিশ্বকাপের দল-সূচি। মোট ১৩টি দেশ নিয়ে মাঠে গড়ায় প্রথম বিশ্বকাপ।
দলগুলোকে চার গ্রুপে ভাগ করা হয়। তিন গ্রুপে তিনটি করে দল, আর গ্রুপ-১ হয় চার দলের। এই গ্রুপে পড়ে ফ্রান্স, মেক্সিকো, চিলি, আর্জেন্টিনা। ঠিক হয় প্রতিটি গ্রুপ থেকে একটি করে দল যাবে নকআউট পর্বে। উরুগুয়ে বিশ্বকাপের নকআউটই ছিল সেমিফাইনাল। সেমিতে নির্ধারিত সময়ে খেলা নিষ্পত্তি না হলে অতিরিক্ত সময়ের নিয়মও করা হয়।
ক্ষণগনণার শেষে আসে বল গড়ানোর সময়। ১৯৩০ সালের ১৩ জুলাই, বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম দুটি ম্যাচ একইসঙ্গে মাঠে গড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র-বেলজিয়াম এক মাঠে, অন্য মাঠে ফ্রান্স-মেক্সিকো। ফ্রান্সের লুসিয়েন লরেন্ট বিশ্বকাপের প্রথম গোলদাতার ইতিহাসে নাম লেখান। ম্যাচের ফল ছিল ফ্রান্স ৪-১ মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র ৩-০ বেলজিয়াম।
প্রথম গ্রুপ থেকে তিনটি ম্যাচ জিতে শতভাগ সাফল্যে সেমিফাইনালের টিকিট কাটে ফেভারিট আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় গ্রুপে ব্রাজিল বলিভিয়াকে ৪-০তে হারাতে পারলেও যুগোস্লাভিয়ার কাছে ২-১এ হেরে যায়। ফলে টুর্নামেন্ট থেকে ব্রাজিলের বিদায়। আর যুগোস্লাভিয়া দুই ম্যাচের দুটিই জিতে সেমিতে। তৃতীয় গ্রুপ থেকে স্বাগতিক উরুগুয়েও দুই জয়ে সেরা চারে আসে, তাদের প্রতিপক্ষ হয় যুগোস্লাভিয়া। আর চতুর্থ গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্র চমক দেখিয়ে বেলজিয়াম-পেরুকে টপকে সেমিতে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ হয়। বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিকও এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের থেকেই।
সেজন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বের্ট পেটেনুদকে ৭৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে করা বের্টের তিন গোলের একটি দীর্ঘসময় অন্যজনের নামে লেখা ছিল। ২০০৬ সালে সেটি সংশোধন করে ফিফা, তাতেই বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিকের মালিকের স্বীকৃতি পান বের্ট।
সেমিফাইনালের দুটি ম্যাচের ফলই ছিল ৬-১ গোলের। প্রথম সেমিতে জয়ী আর্জেন্টিনা, পরের সেমিতে স্বাগতিক উরুগুয়ে। বিদায়ী দুদল খেলে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী। যে ম্যাচের ফল নিয়ে এতটাই বিতর্ক হয়েছে যে বছর চারেক লেগেছে জয়ী দলকে স্বীকৃতি পেতে! তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে যুগোস্লাভিয়া ৩-১ গোলে জিতেছিল বলে খবর এসেছিল। আবার যুগোস্লাভিয়া সেমির ম্যাচের বাজে রেফারিংয়ের প্রতিবাদ জানিয়ে ম্যাচটি খেলেনি বলেও খবর আসে। যুগোস্লাভিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই ক্যাপ্টেনই ম্যাচ শেষে ব্রোঞ্জ পদক নিয়েছিলেন বলেও লেখা চলে অনেকদিন। পরে ফিফার টেকনিক্যাল কমিটি ৫৬ বছর পেরিয়ে এসে একটি রিপোর্ট তৈরি করে যাতে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় ও যুগোস্লাভিয়া চতুর্থ হয়েছে।
উত্তাপটা শুরু হয়েছিল টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই। সেটার রেশ রেখে যাওয়া শেষের ক্ষণটা আসে ৩০ জুলাই। ফাইনালে নামে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। ১৯২৮ অলিম্পিকের দুই ফাইনালিস্ট। বিশ্বকাপ উপলক্ষে নবনির্মিত স্টেডিয়াম মন্টেভিডিওর এস্তাদিও সেন্টেনারিওতে শিরোপা নির্ধারণী লড়াই। ৯৩,০০০ হাজার দর্শকের সামনে ম্যাচ। রেডিওতে ধারাভাষ্য প্রচার প্রথমবারের মতো। কিন্তু খেলা শুরু আগে জটিলতা বাধে কোন দেশের বল দিয়ে ম্যাচ হবে সেটা নিয়ে। কেননা কোনো দলই প্রতিপক্ষের বল দিয়ে খেলতে রাজি নয়। সমস্যার সমাধানটাও ছিল বেশ মজার। বেলজিয়ামের বেফারি জন ল্যাঙ্গেনাস ম্যাচের দুই অর্ধে দুদলের বল দিয়ে খেলা চালানোর সিদ্ধান্ত দিয়ে পার পান শেষঅবধি।
ম্যাচেও অবশ্য দুদলেরই দাপট ছিল। প্রথমার্ধে ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকে স্বাগতিক উরুগুয়েই। দ্বিতীয় অর্ধে ঘুরে দাঁড়ায় তারা। ৪-২ গোলে আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়ে হয় প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
রানার্সআপ হওয়ার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার নিয়েই সান্ত্বনা খুঁজতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। আলবিসেলেস্তেদের গুইলের্মো স্টাবিলে ৮ গোল করেন, একটি হ্যাটট্রিক সমেত। শেষ হয় ১৮ ম্যাচে ৭০ গোলের প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খোঁজার ইতিহাস।