নেত্রকোনা জেলার মোহন গঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের একটি স্বপ্নের নাম শিয়ালজানি।এই স্বপ্নটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বপ্নজাগরণে পরিণত হয়েছিল ২০০৮ সালে। সময়টা ছিল ওয়ান-ইলেভেনের বিরাজনীতিকীকরণের ফখর উদ্দীন -মঈন উদ্দীনের শাসনকাল। সেসময় রাজনৈতিক দলগুলোর কোন কার্যক্রম না থাকায় প্রশাসনের হাতেই ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতা। তখন মোহন গঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আগমন করেন কাজী আবেদ হোসেন নামের একজন গণমুখী ব্যক্তি।
তিনি মোহন গঞ্জবাসীর সাথে কথা বলে উদ্যোগ নেন শিয়ালজানি খাল উদ্ধার ও খননের। শিয়ালজানি এমনই একটা কঠিন জিনিস যে এটাকে ক্ষমতা ছাড়া টলানো সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীও মাঝেমাঝে এ খালে হানা দিয়েছে।কিন্তু তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। কাজী আবেদ হোসেনের ডাকে মোহন গঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ একীভূত হয়েছিল। ২০০৮ সালের শিয়ালজানি খাল উদ্বোধনকে ঘিরে মোহন গঞ্জ হয়ে উঠেছিল উৎসব নগরী। ঢাকা হতে পরিবেশ আন্দোলনের নেতারাও মোহন গঞ্জে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে শিয়ালজানি খননের কাজে যুক্ত হয়েছিল।
বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যমেই সেদিন শিয়ালজানি শিরোনাম হয়েছিল।
ছাত্র,শিক্ষক,চাকুরীজীবী, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কৃষক, মজুর, জোয়ান, বুড়ো সকলেই সেদিন শিয়ালজানি খালে কোদাল নিয়ে নেমেছিল। ২০০৮ সালে মোহনগঞ্জের সন্তান সাংবাদিক আতিক রহমান পূর্নিয়া বাংলা ভিশনে বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করেছিল। ১০ বৎসর পর ২০১৮ সালে ২৮ মে শিয়ালজানি নিয়ে আরও একটি প্রতিবেদন পেলাম তার যার শিরোনাম: অনিয়মের সিসি ব্লক ধসে ভাঙছে মোহনগঞ্জ পৌরবাসীর স্বপ্ন’।
প্রতিবেদনটি দেখলাম একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে, প্রতিবেদনটি হয়েছে স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ দুজনের যৌথপ্রচেষ্টায়। ১০ বৎসর পরে শিয়ালজানি আবারও সংবাদ পত্রে এলো। এবারের বোনাস সংযোজন সোশ্যাল মিডিয়া। শিয়ালজানি খালে সরকারি বরাদ্দের অপচয় নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সংগঠিত হচ্ছে।
শিয়ালজানিকে গ্রাস করে ফেলেছিল অবৈধ দখলদাররা। কাজী আবেদ হোসেন বিরাজনীতিকীকরনের প্রশাসনিক কর্তৃত্বে দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অনেক স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শিয়ালজানিকে মুক্ত করতে জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। তখন হতেই মানুষ শিয়ালজানি নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ফখর উদ্দীন -মঈন উদ্দীনের আমল শেষ হয়ে গেল। দেশে ফের ক্ষমতায় এলো রাজনৈতিক দল। শিয়ালজানি নিয়ে তৎপরতা আস্তে আস্তে কমে গেল। কাজী আবেদ হোসেন শিয়ালজানিকে স্রোতোস্বিনী করতে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সরকারি কোষাগার হতে শিয়ালজানির জন্য অর্থ বরাদ্দ আনতে।
২০০৯ এ ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ। এ অঞ্চলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রেবেকা মমিন। ২০১৪ সালেও ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য হন পুনরায় রেবেকা মমিন। এই দীর্ঘ সময়ে কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি শিয়ালজানি নিয়ে। উদ্যোগ আবার জোরদার হলো বিভাগীয় কমিশনার হতে যখন সাজ্জাদুল হাসান প্রধান মন্ত্রীর একান্ত সচিব: ১ হলেন। ২০০৮ সালে মোহন গঞ্জবাসী যেমন কাজী আবেদ হোসেনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবার তারা উদ্বুদ্ধ করলো সাজ্জাদুল হাসানকে।কারণ শিয়ালজানিতে স্রোত বহাতে চাইলে ক্ষমতা লাগবে।শিয়ালজানি ভারী ক্ষমতা বুভুক্ষু।
প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হওয়ার পর সাজ্জাদুল হাসান বেশকিছু উন্নয়ন কাজ সংগঠিত করেন। হাওর এক্সপ্রেস ও মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামের দুটো ট্রেন চালুতে রাখেন মুখ্য ভূমিকা। অবশ্য মোহন গঞ্জে আন্ত:নগর ট্রেন চালুর ব্যাপারে একসময়ের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের পরিকল্পনাতেও ছিল। সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন ও মোহনগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের কাছে একটি আন্তঃনগর ট্রেন দাবি করেছিল।
সে দাবির সূত্র ধরেই পরবর্তীতে সকলের প্রচেষ্টায় মোহনগঞ্জবাসী পেল হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনটি। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস গাড়িটিতে সাজ্জাদুল হাসানের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। ভূমিকা মানে জনগণের একটি ন্যায্য চাহিদা পূরণে সরকারকে রাজী করানো। মোহনগঞ্জে ২ জন সচিব রয়েছেন তারা পারেন নি।
অতিরিক্ত সচিব হয়ে সাজ্জাদুল হাসান তা পেরেছেন। শিয়ালজানি খাল খননের জন্যও রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ বরাদ্দ নিতে সক্ষম হন তিনি। পরিবর্তন.কমে লিখেছে মোট বরাদ্ধ ১৫ কোটি ২৮ লাখ। এটা দিয়েছে পাউবো। কেউ কেউ বলছে পাউবোর বাইরেও বরাদ্ধ আছে।কিন্তু সরকারি কোষাগার হতে প্রাপ্ত অর্থের কেন সঠিক ব্যবহার হলো না?
চরহাইজদা বাঁধেও বারবার বরাদ্দ আসে ও বারবার ফসল ডুবে।বরাদ্দ এনে বরাদ্দবাজীতে মেতে উঠে একটি অসাধু চক্র।শিয়ালজানি খালও কি তবে সেদিকেই যাচ্ছে? সরকারী বরাদ্দ বের করার আগে এর সুষ্ঠু প্রয়োগের নিরাপত্তাই বেশি গুরুত্ব পূর্ণ নয় কি?ঠিকাদাররা সঠিক কাজ না করেই কিভাবে বিল উঠিয়ে নিল?ঠিকাদাররা যেহেতু ব্যবসায়ী তারা ব্যবসার দিকই ভাববে।সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছে।রয়েছে পাউবো,উপজেলা প্রশাসন।রয়েছে এলাকার সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণ।এত বড় একটা লুটপাট হয়ে গেল কেউ টেরই পেলোনা? সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু সংবাদ পত্রে এই অনিয়ম নিয়ে লেখালেখি না হলে এই লুটপাটের ব্যাপারে কে মুখ খুলতো? স্থানীয় সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন ও জানেন না এ প্রকল্পের অনিয়মের খবর।জানেন না স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।এই প্রকল্প সহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য মোহনগঞ্জবাসী প্রধান মন্ত্রীর একান্ত সচিব:১ সাজ্জাদুল হাসানকে বেশ কয়েকবার সংবর্ধনাও দিয়েছেন। সংবর্ধিত হয়ে তিনি যদি সবাইকে উন্নয়নকাজ গুলো অনিয়ম দূর্নীতিমুক্তভাবে সম্পন্নের কথা বলতেন তাহলে অবশ্যই ভিন্নচিত্র হতো।সোশ্যাল মিডিয়ায় স্তুতিবাক্যের ছড়াছড়ি না করে যদি কাজের তদারকি ও সময়ে এই অনিয়মের তথ্য প্রচার হতো তাহলে নিশ্চয়ই ভিন্নচিত্র হত।হতোনা সরকারি কোষাগারের অর্থের অপচয়। স্বপ্ন ভঙ্গ হতোনা মোহনগঞ্জের মানুষের।
চরহাইজদার মত শিয়ালজানিকে ঘিরেও সরকারি অর্থ লুটপাট শুরু হোক এটা আমরা চাইনা। সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন বলেছেন, এ অনিয়মের সাথে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? সম্ভব হবে কি লুটেরাদের আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে? ক্ষমতা বুভুক্ষু শিয়ালজানির ন্যায্য পাওনা খোদ ক্ষমতাও কেন মিটিয়ে দিতে পারলোনা? সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব: ১(বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সচিব), স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সহ ব্যাপক ক্ষমতার উপস্থিতিকেও কেন কিছু মনে করলোনা অনিয়মকারীরা? অনিয়মকারীরা এই এত জোর কোথায় পেল? সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল, এই কথার প্রচলন শিয়ালজানি নিয়ে স্বপ্ন দেখার লোকেরা চায় না।শিয়ালজানি খালের বরাদ্দ সম্পর্কেও জনগণকে অবহিত করা হয়নি। প্রজেক্টের বর্ণনা, কাজের ধরন,ঠিকাদার ও মোট বরাদ্দ সম্বলিত কোন বিলবোর্ডও রক্ষিত হয়নি। কেন হলোনা এর জবাব কে দেবে? জনগণের টাকায় খাল হবে আর জনগণ তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেনা সেটা হয়না।
সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজ পরিদর্শন ছাড়া ঠিকাদারের টাকা উত্তোলন করার কথা না।এবিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমেরিকা প্রবাসী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মোহন গঞ্জ ডিগ্রী কলেজ সংসদের সাবেক জি,এস মোস্তফা জামান ইদ্রিছী চমৎকার কথা বলেছেন।
তিনি লিখেছেন, ইঞ্জিনিয়ার দস্তখত দিলে সরকার টাকা দেয় । ঠিকাদারদের প্রতিটি কাজ ইঞ্জিনিয়ার সশরীরে উপস্থিত থেকে তদারকি করা তার দায়িত্ব। যদি সম্ভব না হয় যেকোন সময় তার ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে সেই মান নির্ণয় করা তার পক্ষে খুবই সহজ। তাই এখনও সময় আছে ইঞ্জিনিয়ারদের চাপ দিয়ে তার নিকট থেকে সঠিক কাজ আদায় করে নেওয়া।
এইটা জনগণের অধিকার। এই সব কোন দয়া দক্ষিনের বিষয় না। এক কথায় ইঞ্জিনিয়ার হল সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী, দোষী না হলে সে বলুক কে বা কাদের চাপে সে নিম্নমানের কাজে দস্তখত দিল ?
স্বচ্ছতার জন্য জনগণের অবগতির জন্য জানমালের নিরাপত্তার জন্য যে বিষয়গুলো একটি বড় বিলবোর্ডে পরিষ্কার ভাবে লিখা থাকা উচিত ছিল –
১. প্রজেক্টের নাম / নাম্বার/ ঠিকানা ২. অনুমোদিত টাকার পরিমাণ ৩. কাজের ধরন ৪. কাজ শেষ করতে কত সময় প্রয়োজন হবে ৫. জরুরী ফোন নাম্বার ৬. অভিযোগ বক্স ৭. প্রজেক্ট ম্যানেজারের নাম ও ফোন নাম্বার ৮. জরুরী অবস্থায় কার স্বর্ণা পন্ন হতে হবে
৯. সরকারি কোন বিভাগের অধীনে কাজ হচ্ছে ১০. সরকারি ভাবে কে দায়িত্বশীল ব্যক্তি ১০জন।
Construction site ম্যানেজারের নাম ফোন নাম্বার। ১১ . প্রজেক্ট ইজ্ঞিনিয়ারের নাম ফোন নাম্বার ও Email address .
১২. প্রজেক্ট থেকে কি কি ভাবে জন উপকৃত হবে ।
জনগণ এই সবের কিছুই জানে না, জানানো হয় নাই ,জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত ।তারা শুধু দেখছেন শিয়াল জানির পারে সম্মানিত শ্রদ্ধেয় দুই জনের নাম মার্বেল পাথরের উপর সুন্দর করে লিখা ।
শিয়ালজানি খাল খনন কর্মসূচির এরকম কোন বিলবোর্ড নেই। এই প্রকল্পটির ঠিকাদারি পায় ভাওয়াল কনস্ট্রাসন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ভালুকার বিএনপি নেতা ফখর উদ্দীন বাচ্চু।
তিনি ওয়ান ইলেভেন পূর্ববর্তী ২০০৬ সালে বিএনপি হতে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়নও পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। মোহন গঞ্জের অধিকাংশ মানুষই এ তথ্য জানেনা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের তত্ত্ব ও তথ্য কেন গোপন রাখা হলো? ক্ষমতায় শেখ হাসিনার সরকার আর ঠিকাদারি পেল খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন ব্যক্তি এটা কিভাবে?মোহন গঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের স্বপ্নটা কেন আহত হল? ভাওয়াল কনস্ট্রাকসন এত এত ক্ষমতার ভিড়ে কিভাবে মহাক্ষমতাধর হয়ে গেল? জনতার সামনে তার রহস্য উদঘাটন করা হোক।উদ্ধার করা হোক লুণ্ঠিত অর্থ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)