
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বেই চলছে প্রচারণা। বাল্যবিবাহকে ধর্ষণের নামান্তর বলা হচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারগুলোর কাছে স্পষ্ট কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি চাইছে। আমাদের সরকারের একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত এসব বক্তব্যকে যেন প্রহসনে রূপান্তরিত করল।
দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সব রকম ওজর-আপত্তি, আবেদন-নিবেদন, যুক্তি-দৃষ্টান্ত, দাবি-প্রত্যাশাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ পাস করা হয়েছে। এই বিল পাশের মধ্য দিয়ে দেশের মেয়েদেরকে আরও বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।
বাংলাদেশের মত বাল্যবিবাহপ্রবণ দেশে যেখানে দরকার ছিল বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইন, সেখানে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭ নামে একটি ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’র বিধান পাশ করা হলো। বিলটিতে যদিও নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স যথাক্রমে ১৮ ও ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু একটি বিশেষ বিধান যুক্ত করে ১৮ বছরের কম বয়সীদের বিবাহের সুযোগ রেখে দেওয়া হয়েছে। এখন বিলটিতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলেই তা আইনে পরিণত হবে।
সরকারের এই উদ্যোগ বাংলাদেশকে অনেক পেছনে ঠেলে দেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নতুন বিলে ২১ বছরের কম বয়সী ছেলে ও ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের অপ্রাপ্তবয়স্ক বলা হলেও, আইন শিথিলের বিশেষ প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম কোনো বয়সের কথা বলা হয়নি৷ শুধু তাই নয়, বিলে বাল্যবিবাহ বন্ধে কঠোর শাস্তির কথা বলা হলেও অপ্রাপ্তবয়স্করা বিয়ে করলে সর্বোচ্চ মাত্র ১৫ দিনের আটকাদেশ বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে৷ ওই ১৫ দিনের আটকাদেশের মধ্য দিয়েই কিছু বাল্যবিবাহ বৈধতা পেয়ে যাবে, যা বর্তমান আইনের চেয়েও দুর্বল।

নতুন এই আইনটি বাল্যবিবাহ বন্ধে গত কয়েক যুগ ধরে চলে আসা লড়াইয়ের পথে নিঃসেন্দহে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। এই আইন সারা দেশে অভিভাবকদের এই বার্তা দেবে যে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সরকার বাল্যবিবাহকে যৌক্তিক মনে করছে৷ ১৮ বছরের আগেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায়। দেওয়া সম্ভব।
এই আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, ধর্ষণের কারণে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে, তাকেও এই আইন দেখিয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েতে বাধ্য করা হতে পারে।
এই আইন পাসের সময় জাতীয় পার্টির একজন এমপি যথাযর্থই বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু আইনে অনুমতি দেয় না। এক্ষেত্রে ওই লোকটি ফুসলিয়ে কোনো মেয়ের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশার মাধ্যমে যদি তাকে গর্ভবতী করে, তাহলে ওই লোক তো ওই বিশেষ বিধানের সুযোগ নিতে পারবে।’ এমন সুযোগ যে আইনে রাখা হয়, তা কেমন আইন? বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
অথচ দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষ আশা করেছিলো, নতুন আইনটি পুরনো আইনের তুলনায় অনেক ভালো হবে৷ কিন্তু ঘটেছে উল্টো। এটি আগের আইনের চেয়ে দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ। আলোচিত এই বিলটি গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সংসদে উত্থাপিত হয়। পরে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
কমিটি বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও প্রযোজ্য করার প্রস্তাব করেছে। এর আগে মন্ত্রিসভা অনুমোদিত প্রস্তাবিত আইনে এই বিধান শুধু মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। সংসদীয় কমিটি ৯ ফেব্রুয়ারি বিলের প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করে।
মন্ত্রণালয়ের উত্থাপিত বিলের ১৯ দফায় বলা হয়েছে, এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছু থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিয়ে সম্পাদিত হলে তা এই আইনের অধীন অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
এক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটি ‘কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর’ শব্দগুচ্ছ বাদ দিয়ে ‘বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্কের’ এবং ‘মাতা-পিতা’ শব্দের পরিবর্তে ‘পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের’ শব্দগুচ্ছ যোগ করার সুপারিশ করেছে। দেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে না পারার দায় এমনিতেই সরকারের উপর বর্তায়। দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা আর ছেলে-মেয়েদের অশিক্ষাকে বাল্যবিবাহের মূল কারণ ধরা হয়। এই ব্যর্থতা তো প্রথমত সরকারের। সরকার এই দায়মোচনের উদ্যোগ না নিয়ে বরং বাল্যবিবাহকেই উস্কে দেওয়ার পথ করে দিল।
আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জের গরিব, নিম্নবিত্ত পরিবার, নিরক্ষর, আদিবাসীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পরিবারে মেয়েসন্তানকে জন্ম থেকেই বোঝা মনে করে৷ এই মেয়েসন্তানকে যত তাড়াতাড়ি ঘাড় থেকে নামানো যায়, ততই মঙ্গল। অন্তত একটা মুখের খোরাক তো বাঁচবে। তারা ভাবে না, হয়ত জানেও না যে, ১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদের শরীর ও মন তৈরি হবার আগেই যদি বিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাবালিকা মা জন্ম দেয় হয় মৃত শিশু, না হয় অপরিণত বুদ্ধি আর বিকলাঙ্গ শিশুর৷ শুধু তাই নয়, নাবালিকা মায়ের স্বাস্থ্য কম বয়সেই ভেঙে পড়ে। নানারকম জটিলতা ও যৌনরোগের শিকার হয় তারা। এছাড়া এতে ত্বরান্বিত হয় জাতীয় মানব সম্পদের অবক্ষয়। ১৪, ১৫ বা ১৬-১৭ বছরের মেয়েদের বেলাতেও এটাই সত্য। বাল্যবিবাহের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে তাদের সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই কার্যত শেষ হয়ে যায়। বিয়ের পর তারা বরং সন্তান নেওয়া এবং পরিবারের কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে বাধ্য হয়। পরিসংখ্যান বলছে, অল্প বয়সে বিয়ের শিকার মেয়েরা অল্প বয়সেই নিজেদের সকল অধিকার হারায়৷ নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবার সুযোগ তারা পায় না৷ বরং পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় তারা বেশি থাকে।
এটা ভাবলে খুবই বিপন্ন বোধ হয়, মানবিক বোধগুলো অসাড় হয়ে পড়ে, যখন দেখি ছোট ছোট মেয়েদের, যাদের বয়স লেখাপড়া, খেলাধুলা আর আনন্দ-ফুর্তি করার, তখন তাদের জোর করে বিবাহ দিয়ে পরের ঘরে এক অচেনা পরিবেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে ওই বয়সে তাদের হেঁসেল ঠেলতে হয়, বাড়ির পরিজনদের মন রাখতে সেবাদাসি হয়ে দিন-রাত খাটতে হয়৷ আর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেহে রাতে যখন দু’চোখে ঘুম নেমে আসে, তখন স্বামী ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তার কাম চরিতার্থ করে। না বলার জো নেই, কারণ তারা যে গরিব পরিবারের অশিক্ষিত হতভাগ্য নাবালিকা সন্তান৷ অন্যরকম দৈহিক নির্যাতনের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এটা শুধু আমানুষিকতাই নয়, এটা হিংস্রতা, সতীদাহ প্রথার ভিন্নরূপ৷ সেই হিংসরূপটাকে আমরা আইনি প্রটেকশন দিয়ে জিইয়ে রাখছি কেন, কার স্বার্থে?
স্বার্থ অবশ্য একটা আছে, সেটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার স্বার্থ। বাংলাদেশে প্রায় পয়ষট্টি শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই। বাল্যবিবাহের এই হার সরকারের জন্য অস্বস্তির। অনেকের মতে, মুখে যাই বলা হোক না কেন, আইনে কায়দা করে বিবাহের বয়স কমিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার আসলে বাল্যবিবাহের এই হার বদলে দিতে চায়।ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হবে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করে। সরকার যে কারণেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক না কেন, ক্ষতিটা কিন্তু হচ্ছে মেয়েদের এবং শেষ পর্যন্ত পুরো জাতির।কোনো কল্যাণকামী সরকারের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা শুধু হঠকারীই নয়, আত্মঘাতীও বটে।
গায়ের জোরে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করে যে কাজটি করল, তা দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বলা যায়, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে আইনটি বিশ্বব্যাপী একটি কালো আইন হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিশ্বজুড়ে বিবাহকে ভালবাসা, সুখ ও নিরাপত্তার আদর্শ রূপ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ কিন্তু একজন শিশুর যখন বিবাহ হয়, তখন অনেক সময়ই তার কাছে সেটা হয় নিকৃষ্টতম ঘটনা। বাল্যকালে বিবাহের ফলে যে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেখানে প্রায়ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।
বাল্যবিবাহ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়া বা নারী সমাজকে সুরক্ষা দিতে না পারা রাষ্ট্রের কর্তব্য পালনে ব্যর্থতারাই নামান্তর। সরকার ব্যর্থতার এই পাল্লাটাকে আর কত ভারী করবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)