এখানে-সেখানে ছড়ানো ছিটানো পুড়ে যাওয়া টিন, আসবাব। পড়ে আছে আংশিক পুড়ে যাওয়া শখের কোনো জিনিস। কোথাও বা শুধু পোড়া ভিটা। এখন এমনই চিত্র রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকার ইলিয়াস মোল্লা বস্তির।
সোমবার ভোরে লাগা ভয়াবহ আগুনে সেখানকার কয়েক হাজার ঘর পুড়ে যায়। ওই বস্তিতে বসবাস করা মানুষগুলো সবকিছু হারিয়ে আজ অসহায়। জীবনযুদ্ধে সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তারা। আগুনে ঘর বাড়ি পোড়ার সঙ্গে পুড়ে গেছে তাদের হাজারো স্বপ্ন, বেঁচে থাকার সব অবলম্বন।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে ইলিয়াস মোল্লা বস্তি গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া ঘর বাড়ির টিনগুলো সরানো হচ্ছে, তবে সরছে না সাধারণ মানুষের আহজারি।
স্থানীয় এমপির পক্ষ থেকে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা হলেও সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। খাবারের পাত্রের অভাবে এ বিশৃঙ্খলা। সাধারণ মানুষরা কোনো রকমভাবে জীবন পার করছে। এলাকায় দেখা দিয়েছে অস্বাস্থ্য পরিবেশের সঙ্গে পানি সংকটও।
পোড়া ঘরের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বৃদ্ধা হাজেরা খাতুন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘নিজের জান আর পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নাই রে বাজান।’’
নিজের পুড়ে যাওয়া ঘরের মেঝেতে বসেই দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন শাহজাহান ব্যাপারী (৬৫)। তিনি বলেন, ‘মাদারীপুর গ্রামের বাড়িতে ছিলাম ঘরে ভাড়াটিয়া ছিল। দিনমজুরের কাজ করি, এখন কি করুম কিছুই কইতে পারছি না।’
শাহজাহান ব্যাপারীর ছোট্ট নাতি আব্দুল্লাহ নাজমুল বলেন, ‘আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, আগুন লাগার পর ঘর থেকে বাইরে আসি। আমার বইগুলো বাইর করতে পারি নাই, সব পুড়ে গেছে।’
ভয়াবহ এই আগুনে সহায়-সম্বল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই বস্তির বাসিন্দারা। পুড়ে ছাই হয়েছে বস্তির ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ঘর-বাড়ি, সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে যেন হাজারো স্বপ্নও।
সব হারিয়ে দিশেহারা বস্তিবাসী সালমা বেগম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘খাট, টিভি শোকেস কিছুই উদ্ধার করতে পারি নাই। স্বামীকে বিদেশ পাঠাবো, বিদেশ যাওয়ার সব কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার স্বপ্ন সবশেষ।’’
মোহম্মদ হারুন বলেন, ‘ব্যাংক থেকে টাকা তুলব সেটাও পারছি না চেক সব পুড়ে গেছে।’ তিনটি ঘর নিয়ে থাকা হারুন খানিকক্ষণ পর পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন।
মঙ্গলবার সকালে ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আমি ত্রাণমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য ১০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে দশ লক্ষ টাকা।’
‘ঢাকার ডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে তাদের তালিকা যত দ্রুত তৈরি করতে। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বস্তিবাসীদের জন্য তাদের স্থায়ী আবাসন করতে সরকার বাউনিয়ায় বিরাট এলাকাজুড়ে পুনর্বাসনের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। দীর্ঘস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা সরকার হাতে নিয়েছে।’
তবে আগুন লাগার কোনো কারণ জানতে পেরেছেন কি না জানতে চাইলে সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, ‘আগুন লাগার কোনো কারণ জানা যায়নি, এ ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। শিগগিরই কীভাবে আগুন লেগেছে তা বেরিয়ে আসবে।’
কী কারণে আগুন লেগেছে তা বস্তিবাসী বা ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য জানানো হয়নি। ওই সূত্রগুলোর ধারণা, রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা অথবা বৈদ্যুতিক শটসার্কিট বা সিগারেটের আগুন থেকে সেখানে আগুন লাগতে পারে। ভয়াবহ আগুনে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা টানা সাড়ে ৪ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
আগুনের উৎস ও ক্ষতি খতিয়ে দেখতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, হারুনাবাদ এলাকায় পাশাপাশি ৩টি বস্তি রয়েছে। কবির মোল্লার বস্তির পাশে সাত্তার মোল্লা ও নাজির আলির বস্তি। কবির মোল্লা বস্তির আয়তন প্রায় ২৫ একর। আগুনে বস্তির প্রায় চার হাজার ঘর ভূস্মীভূত হয়েছে।
এই বস্তিতে প্রায় ২৫ হাজার লোকের বসবাস। বস্তির ঘরগুলো ছিল ঘিঞ্জিমতো। একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। ফাঁকা স্থান তেমন ছিল না বললেই চলে। একটি কক্ষে অনেকেই ঠাসাঠাসি করে থাকেন। অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। আবার বস্তিতে প্রায় অধিকাংশ দক্ষিণ অঞ্চলের নদীভাঙা লোকজনের বসবাস। কেউ গার্মেন্টসকর্মী, কেউ রিকশাচালক, কেউ দিনমজুর।