Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

বরাদ্দের নামে বরাদ্দ বাণিজ্য!

মন্ত্রী, সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বারদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ এসে থাকে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মন্দির, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, খেলার মাঠ প্রভৃতি খাতে সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে প্রতি বছরই বরাদ্দ দেয়া হয়। আরও রয়েছে অসহায় দুঃস্থদের ঘর নির্মাণের জন্য ঢেউটিনের বান্ডিল ও নগদ টাকা বরাদ্দ। সম্প্রতি যোগ হলো ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ।

কিন্তু এসব বরাদ্দের প্রাপ্তি, বিতরণ বা প্রয়োগের বাস্তব চিত্র কী, এর কত ভাগ যথাস্থানে পৌঁছায় অথবা কাজে লাগে – এই প্রশ্নের উত্তর কেউ কি জানার চেষ্টা করেন? এই বরাদ্দ প্রাপ্তিধন্য জনেরা রাতারাতি আখের গুছিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে। অনেক বরাদ্দ নূন্যতম কাজ না করেই সুবিধাভোগীদের দ্বারা পুরোটাই লুটপাট হয়ে যায়। কবরস্থানের নামে বরাদ্দ এনে কোনো কবরে এক কোদাল মাটি না দিয়ে পুরো বরাদ্দই নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু বরাদ্দভুকেরা মন্দির মসজিদের নামে বরাদ্দ এনে নয়ছয় করে অর্ধেকের বেশি আত্মসাৎ করে অহরহ অসাধু চক্রের লাভবান হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

দেশ জুড়েই চলছে এই বরাদ্দ বাণিজ্য। যে যত বেশি বরাদ্দ আনতে পারে সে তত বেশি লাভের মুখ দেখতে পায়। এজন্যই তারা মন্ত্রণালয়ে কমিশন দিয়ে হলেও বরাদ্দ পেতে আগ্রহী হয়। এভাবেই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত – মন্ত্রণালয় থেকে সাংসদ, সাংসদের পিএস, এপিএস, ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী নেতা, পিআইও, চেয়ারম্যান, মেম্বারও প্রকল্প বাস্তবায়নের স্থানীয় কমিটি পর্যন্ত এসে চেষ্টা চালান।opinion_boraddo3

মোট বরাদ্দের শতকরা কতভাগ কাজ হয়ে থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর জনসম্মুখে প্রকাশিত হলেই উন্নয়নের আসল চিত্র ফুটে উঠবে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, যে খাতে বরাদ্দ এলো সে খাতে বরাদ্দ প্রয়োগের খবর কেউ রাখে না। বরাদ্দের পরিমাণ দেখে উন্নয়ন হচ্ছে বলা যায় না। বরাদ্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও ব্যবহার যদি হয়ে থাকে, তখন বলা যায়। দেশে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয় তা যদি নয়ছয় না হয়ে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকত তাহলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত।

উন্নয়নের পথে প্রধান বাধাই হচ্ছে এই নয়ছয়, লুটপাট ও সিন্ডিকেটের খপ্পড়ে পড়া। যে চাল অথবা গম মসজিদ অথবা মন্দিরের নামে বরাদ্দ থাকে সেই চাল, গম মসজিদ মন্দির কমিটির ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করারও সুযোগ নেই। বরাদ্দ অনুমোদন দেবে সাংসদ আর বলে দেবে ডিও-টা যেন অমুকের (অমুক মানে সাংসদের ঘনিষ্ঠজন) কাছে বিক্রি করা হয়। আর অমুক তখন বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দাম বলবে। মূল্য যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যতামূলকভাবেই তার কাছে বিক্রি করতে হয়। প্রতি জেলা,উপজেলাতেই এরকম সিন্ডিকেট চালু রয়েছে।

বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ প্রভৃতির নাম তালিকাভুক্তিতেও রয়েছে উৎকোচ বাণিজ্য। ২ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয় এসব নামের তালিকাভুক্তিতে।যার ফলে দেখা যায় প্রায় এক বছরের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা আগাম চলে যায় অসাধু চক্রের পেটে। সম্প্রতি ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণেও  চাঁদাবাজি ও নানা অনিয়মের কথা শোনা যাচ্ছে।যাদের দেয়ার কথা তাদের না দিয়ে নিজেদের উদরেই ভরে নিচ্ছে এই অসাধু চক্র।

opinion_boraddo4কারা এই অসাধু চক্র? কেউ সাংসদের লোক, কেউ সরকার দলীয় চেয়ারম্যানের লোক, কেউ সভাপতি সম্পাদকের লোক। এই অসাধু চক্র ১০ কেজি চাল ইস্যুতে নিজেরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাণিজ্য করে যাচ্ছে।

এই অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আর্তমানবতার সেবায় কী উপকার করছে তা সহজেই অনুমেয়। গ্রামের অসহায় অশিক্ষিত মানুষগুলো সুদের ওপর টাকা নিয়ে চাঁদা অথবা উৎকোচ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদের নিরাপত্তা হারাচ্ছে। ঋনভারে জর্জরিত হচ্ছে তারা। এভাবেই বরাদ্দের নামে বরাদ্দ বাণিজ্য হরণ করছে মানুষের নিশ্চিন্ত বসবাসের নিরাপত্তা।

৩০ কেজি করে দিতে বলা ভিজিডির বেলায় ভিজিডি গ্রহণকারী পায় মাত্র ১৭/১৮ কেজি চাল। অনেক ক্ষেত্রে আধাআধিও হয়ে থাকে। ১০ কেজি করে দিতে বলা ভিজিএফের চালে তালিকাভুক্ত হতদরিদ্ররা পায় মাত্র ৬/৭ কেজি করে। আর রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট ও সরকারি ভবন বরাদ্দের টেন্ডারে তো কোটি কোটি টাকার নয়ছয় হয়। ষোল আনার মধ্যে চার আনা অর্থও নির্মাণকাজে ব্যয় হয় না।opinion_boraddo2

অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া বিল ভাউচার ও রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে পুরো বরাদ্দই রাক্ষুসে বোয়ালদের পেটে যায়। বোয়ালরা তাদের বোয়ালত্ব নির্বিঘ্ন করার জন্য শোল, গজার, শিং ও পুঁটি মাছদেরও কিছু ভাগ দিয়ে থাকে। যাতে এসবের কোনো প্রতিবাদ না হয়।পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা করার চেয়ে এইসব বরাদ্দ বাণিজ্য বেশি লাভজনক বলে যে যতবেশি বরাদ্দ পায় সে ততবেশি ধনশালী হয়। দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে হলে এইসব বরাদ্দ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।বরাদ্দগুলোর যথাস্থানে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Exit mobile version