করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, অর্থ আত্মসাৎসহ বিবিধ প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম গ্রেপ্তার হয়েছেন। আলোচনায় আসার কয়েকদিনের মাথায় তিনি গ্রেপ্তার হলেন। বুধবার ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর সীমান্ত এলাকা থেকে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের সময়ে তার সঙ্গে গুলিসহ অবৈধ একটি অস্ত্রও ছিল। র্যাব এই অস্ত্রও উদ্ধার করেছে। ভাগ্য ভালো যে এই গ্রেপ্তারের সময়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি! বিভিন্ন মাধ্যমে প্রদর্শিত ছবিতে দেখা যায় গ্রেপ্তারের পর হাতকড়া পরা থাকলেও তার কোমরে একটা অস্ত্র বাঁধা ছিল। বাদামি রঙের ওই অস্ত্রের ভেতর গুলিও ছিল হয়ত। র্যাব সূত্রে জানা যাচ্ছে, সাহেদ গ্রেপ্তার এড়াতে গোঁফ কেটেছেন, বোরকা পরেছেন।
করোনা পরীক্ষা নিয়ে নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত ছিল। দেশ ছাপিয়ে এটা বাইরের দেশগুলোতেও আলোচনার খোরাক হয়েছিল। এই জালিয়াতির কারণে ইউরোপের দেশগুলোর দ্বার বাংলাদেশের জন্যে বন্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম। ইতালিতে ভুয়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ধরা পড়ে যাওয়ার পর সেই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে বিমান যোগাযোগ আপাত বন্ধ রয়েছে। এটা নিয়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে আলোচনা চলছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশিদের ‘ভাইরাস বোমা’ বলেননি। ধরে নিচ্ছি তিনি সেটা বলেননি কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে ইতালি যে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং থাকছে সেটা নিশ্চিত। এতে করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
ইতালি প্রবাসীদের কয়েকজনের জাল করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট যারা দিয়েছে তারা এদেশিয় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় রয়েছে, তারচেয়ে বেশি দায় সরকারের কারণ তারাই কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল। এবং এই অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক যে করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল সেটা ত প্রমাণিতই। রিজেন্ট হাসপাতাল কিংবা জেকেজি হেলথকেয়ার নিয়ে যে আলোচনা চলছে তাদের সঙ্গে সরকারই চুক্তি করেছিল। সেখানে সরকারের মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। যদি বেকায়দায় পড়ে এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন তিনি এই চুক্তির বিষয়ে ‘কিছুই জানেন না’।
‘কিছু জানি না’ বিষয়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই ধরনের মন্তব্য নতুন কিছু নয়। করোনার সময়ে তিনি একাধিকবার একই কথা বলেছেন। করোনার শুরুতে সাধারণ ছুটির সময়ে হঠাৎ করে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া বিষয়ে তিনি বলেছিলেন তার সঙ্গে কেউ আলোচনা করেনি। অসহায় আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন করোনা বিষয়ক কমিটির প্রধান হলেও তার সঙ্গে কেউ আলোচনা করেনি, তিনি কিছুই জানেন না। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছু বলতে পারেন না। অর্থাৎ যখনই বেকায়দায় পড়েন তখনই ‘আমি কিছু জানি না’ বলতে পছন্দ করেন তিনি। তার ধারণা এতে করে দায়মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন তিনি, কিন্তু আদৌ কি তাই? মোটেও না, কারণ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে যা তার জানার কথা সেটা যখন না জানেন তখন পুরো ব্যবস্থাপনা যে প্রশ্নবিদ্ধ হয় সেটা তিনি অনুধাবন করতে পারেন না। দুঃখজনক এই অজ্ঞতা কিংবা দায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা।

রিজেন্ট হাসপাতালের এই সাহেদের বহুমাত্রিক প্রতারণার খবর নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। গত ৬ জুলাই র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের প্রথমে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে অবস্থিত রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর মিরপুরে রিজেন্টের অন্য শাখায় অভিযান পরিচালনার আগ পর্যন্ত মোহাম্মদ সাহেদ ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন নেতা। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারক এবং সুশাসনের জন্যে জান কোরবান দেওয়া এক ব্যক্তিত্ব। র্যাবের ওই অভিযানের পর পালটে গেছে দৃশ্যপট। এখন তিনি দলে আগের মত সমাদৃত হচ্ছেন না। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথার ফুলঝুরি ফোটালেও এখন আওয়ামী লীগই তাকে অস্বীকার করছে। ওইসব চ্যানেলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য হিসেবে পরিচিতি পেলেও এখন এই দলটাই তাকে অস্বীকার করছে। বলছে- সাহেদ আওয়ামী লীগের কেউ নন। অথচ আওয়ামী লীগের উপকমিটির বিভিন্ন সভায় তার উপস্থিতি ছিল। সেই উপস্থিতির সময়ে এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দলের নাম ও পদবি ব্যবহার করলেও কেউ তখন সেটা অস্বীকার করেনি, বরং সেটাকে গ্রহণ করেছে।
সাম্প্রতিক আওয়ামী লীগের এই খাসলত নতুন ঘটনা নয়। জিকে শামীম, পাপিয়াসহ যারাই নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে তাদেরকে অস্বীকার করে গেছে আওয়ামী লীগ। এতে করে দলটি ভেবেছে দায়মুক্তি পেয়ে গেছে, কিন্তু আদতে সেটা হয়নি। উলটো দল ও সরকারের ভাবমূর্তি আরও বেশি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এদেরকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তারা, তবে কাদের মাধ্যমে কথিত এই অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রতীকী হলেও শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে শামীম-পাপিয়াসহ যারাই আইনের মুখোমুখি হয়েছে তাদের ঘটনাগুলো সামগ্রিকভাবে ব্যাপক প্রভাববিস্তারী না হয়ে সেটা ব্যক্তিপর্যায়ের শাস্তি হিসেবে থেকে গেছে। অথচ এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা অপরাধী হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এটাকে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা যেত। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটেনি।
সাহেদের সঙ্গে সহাস্য ছবিতে সরকার ও আওয়ামী লীগের অনেকেই ছিলেন। সাংবাদিকদের অনেকেই ছিলেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রণব মুখার্জি, লালকৃষ্ণ আদ্ভানির ছবিও ছিল। এই ছবিগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতার সূচক। এখানে অস্বীকারের কিছু নাই, বরং অস্বীকার সন্দেহের সৃষ্টি করে। যেসকল মন্ত্রী-নেতা বলছেন সাহেদ আমাদের কেউ নন, সাহেদের সঙ্গে হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠতার কথা সেইসকল মন্ত্রী-নেতার সঙ্গেও ছিলেন সাহেদ। বিএনপি নেতাদের সঙ্গেও তার সদ্ভাব ছিল যা কিছু ছবিতেও প্রমাণ হয়।
যাই হোক, সাহেদকে গ্রেপ্তারের সময়ে তার কাছ থেকে একটা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কথা আমরা র্যাব সূত্রে জেনেছি। গ্রেপ্তার পরবর্তী কোমরে গুঁজে রাখা বাদামি রঙের একটা পিস্তলের ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এ নিয়ে, প্রশ্নটাই স্বাভাবিক কারণ ফটোসেশনকালেও কোমরে থাকা পিস্তল অস্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া অপরাধী ধরতে কোথাও অস্ত্রের সংযোগ থাকলে সেখানে বেশিরভাগই ক্ষেত্রে আমরা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও ঘটতে শুনে আসছি। কিন্তু এখানে সেসবের কিছুই ঘটেনি। বলছি না, সাহেদকে বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে মেরে ফেলতে, কারণ এটা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু ফটোসেশনকালেও কোমরে গুঁজে থাকা পিস্তলসদৃশ বস্তুর উপস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নেওয়া হবে। জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে অজানা অনেক কিছুই হয়ত জানা যাবে। জানি না শেষ পর্যন্ত তিনি বিচারিক পর্ব ও শাস্তির মুখোমুখি হবেন কিনা, তবে এটা আমরা চাই। গ্রেপ্তার পরবর্তী ফটোসেশনের সময়ে কোমরে থাকা পিস্তলের ছবি আমাদেরকে বিচারবহির্ভূত অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে যদিও।
যেভাবেই হোক মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই গ্রেপ্তারটা আমরা চেয়েছিলাম। প্রথম পর্বের সমাপ্তির পর এবার দ্বিতীয় পর্ব হোক তার সঙ্গে জড়িত থাকা অন্যান্যদের আইনের আওতায় আনা এবং এর পরের পর্ব হোক বিচারিক পর্বের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা। এখানে মাঝামাঝি কোনোকিছুর পথে না হেঁটে আমরা চাই আইনের কার্যকর ও যথাযথ প্রয়োগ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)