বাউলের এই মুক্তি শুধু রাষ্ট্রের, দেশের বা সমাজের মুক্তিতে শেষ হয় না, তাঁরা আত্মমুক্তির পথ খোঁজেন । লিখেছেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য।
‘‘ওইরূপ যখন স্মরণ হয়
থাকেনা লোক-লজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে সদায়
প্রেম যে করে সে জানে’’
—ফকির লালন শাহ
এই শতকের সাধক বাউল শাহ আব্দুল করিম বলতেন, ‘‘গুরু আমাদের মন্ত্র নয়, মন্ত্রণা দেন ।’’ জিগ্যেস করলাম, মন্ত্রণাটা কী? বললেন, ‘‘আমাদের গানই আমাদের মন্ত্র, আমাদের মন্ত্রণা।’’ আসলে, বাউল-ফকির সহ গৌণধর্মের সাধকরা তাঁদের সাধনার পথ, তাঁদের মতাদর্শ, তাঁদের বয়ান রচনা করেন গানে গানে। আর এ এমনই বয়ান, যেখানে পরতে পরতে আমাদের চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস, ধর্মবোধ, জীবনচর্চাকে ফাঁসিয়ে দিতে থাকে। প্রচলিত শাস্ত্রশিক্ষা বলে, সাধনা হয় ঈশ্বরের আর বাউল-ফকিররা বলেন দেহ-সাধনার কথা। শাস্ত্র বলে, পুঁথি, আচার, জ্ঞান আর বাউলরা বলেন, মন আর মনের মানুষ। শাস্ত্র বলে, জাহির (প্রকাশ) আর বাউলরা বলেন, বাতুন বা বাতিন (গোপন)। আর ঠিক এ ভাবেই আমাদের প্রান্ত ঘিরে গড়ে ওঠে এক সমান্তরাল জীবনচর্চা, এক সমান্তরাল বিকল্প দর্শন। যা আমাদের চেনা-জানা ছককে ভেঙে দেয়, প্রশ্ন করে আমাদের নিত্য নৈমিত্তিককে। প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙে তাঁরা এক নতুনের মুক্তি সন্ধান করেন বলেই অবলীলায় বলতে পারেন ‘‘খোদ-ই খোদা আল্লার রাধা দোস্তের মোহাম্মদ।’’
এমনকী আজ থেকে দেড়শো বছর আগে লালন শিষ্য দুদ্দু শাহ বলে ওঠেন, মহম্মদের জন্ম যদি আরবে না হয়ে বাংলাদেশে হতো, তবে তো মহম্মদও বাংলাতেই কথা বলতেন। আর দুদ্দুর গুরু লালন তো সব সীমারেখা ভেঙে কবেই জানান দিয়েছেন, ‘‘আপন দেহ সৃষ্টি করলে সাঁই/ শুনি মানবের উত্তর কিছু নাই/ দেহ দেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে/ মন যা কর ত্বরায় এই ভবে।’’ মনে পড়ছে কি, সপ্তম শতকে পারস্যের সুফি সাধক মনসুর হল্লাজ বলেছিলেন, ‘আনাল হক’ মানে আমিই সে বা আমিই ঈশ্বর। আর এই বলার জন্য তাঁকে শূলে চড়তে হয়েছিল। ‘‘বাউল-ফকির ধ্বংস ফতোয়া’’, যার জের আজও চলছে। আজও দুই বাংলা জুড়েই তাঁদের উপর অত্যাচার জারি রয়েছে। ক’দিন আগে তো খোদ লালন ভূমিতেই আক্রান্ত হলেন বাউলেরা। কেন বার বার এই আক্রমণ? কারণ তাঁরা অন্য স্বপ্ন দেখেন, অন্য জীবন, অন্য দর্শনের কথা বলেন। যা আমাদের খাপে খাপ তো খায়ই না, বরং ভেঙে দিতে থাকে আমাদের রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক বিশ্বাস। তাই শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজ শাসন চালায় তাঁদের ওপর। আবার এ-ও সত্য, দেড়শো-দু’শো বছর আগে বাংলায় একপ্রান্তে থাকা জমিদার হাছন রাজা তাঁর সাতপুরুষের জমিদারি থাকতেও প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে হয়তো মনসুর হল্লাজের সুরে সুর মিলিয়েই বেঁধেছিলেন তাঁর গান: ‘‘আমি হইতে আল্লাহ-রসুল আমি হইতে কূল/পাগল হাছন রাজা বলে তাতে নাই ভুল।’’ আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর হিবার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতায় উদ্ধৃত করেছিলেন হাছন রাজার এই পদ।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ সার্কুলার জারি হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ একের পর এক স্বদেশি গান রচনা করে তাঁর স্বদেশি গানে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, তার নাম দেশ, স্বদেশ, মুক্তি, স্বাধীনতা ইত্যাদি কিছুই ছিল না, সে বইয়ের নাম ছিল ‘বাউল’। অবশ্যই স্বদেশি গানের প্রচুর গানই ছিল লোকসুর বা লোক-আঙ্গিকে। যাকে বলা হয় ‘বাউলাঙ্গের গান’। কিন্তু সে বইয়ে ছিল অনেক টপ্পা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ইত্যাদি লোকসুরের বাইরেও অনেক স্বদেশি গান। তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এবং রবীন্দ্রনাথ তো কখনওই তাঁর ‘বাউলাঙ্গের গান’কে বাউল গান বলে দাবি করেননি। বরং বলেছেন, ‘‘আমার গান বাউলের গান নহে।’’ তবে কেন এই স্বদেশি গানের সংকলনের নাম ‘বাউল’? না, রবীন্দ্রনাথ এর সরাসরি কোনও উত্তর দেননি। কিন্তু আমরা এই উত্তর পরে পেয়ে যাই যখন দেখি, ফাল্গুনী থেকে শুরু করে রক্তকরবী-সহ প্রায় সব নাটকেই কখনও বাউল, কখনও বৈরাগী, কখনও পাগল, কখনও বা অন্য কোনও নামে এমন একেক প্রান্তিক চরিত্রকে উপস্থাপন করেন যাঁরা আপনমনে গান তো গায়ই, উপরন্তু এমন এক সামাজিক অবস্থান তারা নেয় যা আদতে প্রশ্ন করে আমাদের জরাজীর্ণ বন্ধ্যাকে, যারা ভাঙতে চায় অচলায়তন বা যক্ষপুরীর গরাদ, যারা মুক্তির কথা বলে। তবে বাউলের এই মুক্তি শুধু রাষ্ট্রের, দেশের বা সমাজের মুক্তিতে শেষ হয় না, তাঁরা আত্মমুক্তির পথ খোঁজেন। তাই বোধহয় লালন ফকির তাঁর সাধনসঙ্গীতের ভণিতায় বলে ওঠেন:
‘‘পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
আমার যম যাতনা সকল যতো দূরে
সে আর লালন একখানে রয়
শুধু লক্ষ যোজন ফাঁকরে’
আবার ফিরে আসি, শেষে বাউল শাহ আব্দুল করিমের কথায় । তিনি বলতেন, ‘‘আমি স্বপ্ন দেখি এই পৃথিবী একদিন বাউলের পৃথিবী হয়ে যাবে।’’ জিগ্যেস করেছিলাম, মানে? সারা পৃথিবীতে সবাই বাউল হয়ে যাবে? বাউল গান গাইবে? বাউলের পোশাক পরে? তিনি বললেন, ‘না তা নয়। আমরা বাউলরা তো মানুষের কথা বলি, মনের মানুষের কথা…। স্বপ্ন দেখি, পৃথিবীটা একদিন মানুষের পৃথিবী হয়ে যাবে।’
এ বছর বাউল শাহ আব্দুল করিমের জন্মশতবর্ষ। আসুন, আমরাও স্বপ্ন দেখি বাউলের পৃথিবী…জয় গুরু!
আনন্দবাজার, ১৫.০৮.২০১৬