কিছুদিন আগে বিছানায় লেগে থাকা পিরিয়ডের রক্তের ছবি দিয়ে ফেসবুকে এক নারী পোস্ট করেছিলেন। ইনবক্সে তাকে কয়েকজন পুরুষ ফেসবুকার প্রশ্ন করেছিলেন এ ধরণের ছবি তিনি কেন দিলেন? এটা অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়েছে বলে তাদের অভিমত। আরেকটু পেছনে গেলে দেখা যায়, ধর্ষণ আর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ লিখে সেটা গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেয় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা। সেটার বিষয়েও দেখা গিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
নারীর বয়:সন্ধিকালের অন্যতম একটি শারিরীক বৈশিষ্ট্য পিরিয়ড বা মাসিক। প্রতিটি মেয়ের জন্যই এটি একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। নারীদেহকে সুস্থ ও সন্তানধারণে সক্ষম করতে এই প্রক্রিয়া অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়াকে মেয়েরা দেখে ট্যাবু হিসেবে। আর সমাজ তো এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে এখন পর্যন্ত প্রস্তুত নয়।
সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম একবার যুক্তি দিয়েছিলেন, মানব ইতিহাসে ধর্মের উৎপত্তিই নাকি ঋতুস্রাবকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি ধর্মেই ঋতুস্রাবে কি করা যাবে বা যাবে না সেটা বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। খ্রিস্টধর্মে ঋতুস্রাব বিষয়ে নারীদের শুচিতা নিয়ে তেমন প্রশ্ন না থাকলেও নারীদের যাজক হতে না পারার পেছনে একটা বড় কারণ এই ঋতুস্রাব। হিন্দুধর্মে ঋতুস্রাবকালীন নারীদের অশুচি বলে গণ্য করা হয়। তাদের রান্নাঘরে কিংবা মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। ইসলামধর্মে ঋতুস্রাবকালীন নারীদের নামাজ পড়া মানা, কাজা নামাজও আদায় না করতে হয় না; রোজা বাদ গেলে সেগুলো পরে পূরণ করে দিতে হয়। ঋতুস্রাবকালে কাবা প্রদক্ষিণ না করলেও হজ কার্যকর হয়।
ডয়চে ভেলে’র ২০১৬ সালের ১৫ জুনের একটি প্রতিবেদনে সমাজে মাসিক বা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড নিয়ে কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে মাসিক হলে চুল ধোয়া যাবে না, মাসিক হলে পুকুরে সাঁতার কাটা যাবে না, কোথাও কোথাও গাছে পানি দিতে দেয়া হয় না, রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়া হয় না কিংবা আলাদা বিছানায় শুতে দেয়া হয়। বাংলাদেশেও অঞ্চলভেদে ঋতুস্রাব নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ট্যাবু দেখা যায়। টক খেতে দেয়া হয় না, কোথাও কোথাও দুধ কিংবা কলা খেতে দেয়া হয় না। পুরুষ মানুষের আশেপাশে যেতে দেয়া হয় না। বিশেষ করে পিরিয়ডকে এমনই শ্রবণের অযোগ্য বিষয় হিসেবে দেখা হয়, একজন কিশোরী সে ছোটবেলা থেকেই এটাকে দেখে একটা ভয়ের বিষয় হিসেবে। প্রথম কয়েকদিন স্কুলে বা বাইরে যেতে দেয়া হয় না। ভয়ে অনেকে বলতেও পারে না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেটে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা টয়লেটগুলোতে নেই স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ডিস্পেন্সারের ব্যবস্থা। পানি কিংবা সাবানের ব্যবস্থাও খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার আর যৌনাঙ্গের নানা ইনফেকশন জাতীয় সমস্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে। এর অন্যতম একটি কারণ প্যাড ব্যবহারে অসচেতনতা। গ্রামে অনেক নারীরা এখনও পিরিয়ডের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানে না। তুলা কিংবা কাপড় ব্যবহারে তারা স্বচ্ছন্দ। ২০১৭ সালে ঋতু বেসলাইন সার্ভে থেকে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ৯১% নারী পিরিয়ডে কাপড় ব্যবহার করেন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশে এক কিশোরীর পেট থেকে সাপের বাচ্চা বের করা হয়। এর কারণ ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহৃত কাপড়ে সাপের ডিম লেগেছিলো। দাম বেশি দেখে অনেকেই মানসম্মত প্যাড ব্যবহার করতে চান না। কিন্তু ন্যূনতম দামে যে প্যাড পাওয়া যায় সেটা অনেকেই জানেন না। প্যাডগুলো অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর, কারণ সহজে পানিতে ডিসপেন্স করা যায় না আবার মাটিতেও মেশে না।
আধুনিক সমাজের নারী ও পুরুষ বিভিন্ন বিষয়ে কুসংস্কারমুক্ত হতে পারলেও পিরিয়ডের বিষয় নিয়ে উভয়পক্ষের কোন ধরণের সংকোচ ছাড়া কথা বলার দৃষ্টান্ত বিরল। কোন দোকানে এমনভাবে ঋতুকালীন ব্যবহার্য পণ্য বিশেষ করে স্যানিটারি প্যাড বিক্রি করা হয় যেন এটা নিষিদ্ধ কোন দ্রব্য। এমনকি প্যাডের নামকরণও যথেষ্ট সার্থক-‘হুইসপার’ অর্থাৎ এগুলোর বিষয় গোপন থাকাই বাঞ্ছনীয়।
বিএনপিএস ও রেড অরেঞ্জ কমিউনিকেশন্সের ঋতু নামের একটি প্রজেক্টে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে যেকোন বয়সী নারীদেরই বিশাল আপত্তি। কাজটি ছিলো স্কুলে পড়ুয়া মেয়েদের নিয়ে। স্বভাবতই ওইটুকুন মেয়েরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চায় না। মেয়েদের হয়ে অনেকসময় তাদের মায়েরা কথা বলছে এবং সেখানেও তাদের ব্যাপক আপত্তি।
উপরে দুটি উদাহরণ দিয়েছিলাম, একটিতে পিরিয়ডের প্রতি ছেলেদের অজানা কৌতুহল ও যথাযথ শিক্ষা না থাকায় জীবনের কোন পর্যায়ে মা, স্ত্রী কিংবা কন্যার বিশেষ প্রয়োজনকে তারা বুঝতে পারে না। অনেক পুরুষ এ বিষয়ে নারীকে দোষারোপও করে থাকেন। আরেকটিতে স্বল্প হলেও এ নিয়ে সচেতনতা তৈরির পথের একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম।
আমাদের দেশে সেক্স এডুকেশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় ছেলে-মেয়ে উভয়ই উভয়ের কাছে বিশাল রহস্যের আধার। গার্হস্থ্য অর্থনীতির বইতে মেয়েদের কিছু বিষয় থাকলেও ছেলেদের বয়:সন্ধির বিষয় আরো উপেক্ষিত। ঋতুস্রাবের সময়ের যে সচেতনতা সেটার জন্য আলাদা করে কোন আলোচনা নিজের ঘর ছাড়া কোথাও হয় না। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভের ২০১৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৬% ছাত্রী ঋতুকালীন সচেতনতা বিষয়ে স্কুল থেকে জানতে পেরেছে। যারাও জেনেছে, তাদের শিক্ষকরা কেবলমাত্র রিডিং পড়ে গিয়েছেন এ বিষয়ে কোন কিছু না বুঝিয়ে।
আজ ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস। সচেতন আমরা তখনই হবো যখন ট্যাবু ভেঙে এটা নিয়ে নারী-পুরুষ সবাই কথা বলবে। ঋতুকালে ব্যবহৃত পণ্যের দাম কমানোর জন্য সরকারকে বোঝাতে হবে। ২০১৬’র শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব নিয়ে একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়। সেখানে বেশ কয়েকটি রাজ্যে ঋতুস্রাবে ব্যবহৃত পণ্যের উপর ভ্যাট তুলে দেয়ার আইনও পাশ হয়। একই সাথে অ্যাক্টিভিস্টরা কাজ করছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিরিয়ডের বিভিন্ন সামগ্রী যাতে ফ্রি দেয়া হয় সে বিষয় নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমরাও এ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারি। স্কুলে স্কুলে ক্যাম্পেইন করা যায়, যাতে করে ঋতুস্রাবকে জুজু হিসেবে না দেখে সহজ স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখতে পারে আমাদের কন্যারা।
পিরিয়ড বা ঋতু বিষয়ে জানাতে এনজিওগুলোর রয়েছে বিভিন্ন ওয়েবসাইট। যেমন: ব্র্যাকের ‘মায়া আপা’। দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকাও একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। আছে পিরিয়ড ট্র্যাকার, কুল, আইপিরিয়ড নামে নানা ধরণের অ্যাপ। তবে প্রান্তিক নারী কিংবা স্কুলের বাচ্চাদের কাছে এ বিষয়ে আরো ভালোভাবে জানাতে একতরফা তথ্য প্রদানই কার্যকর হবে না। জানতে হবে কিভাবে তাদের কাছে আরো সহজে বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)